ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমাজে ওদের পরিচয় পথশিশু টোকাই

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৩ জানুয়ারি ২০১৫

সমাজে ওদের  পরিচয়  পথশিশু  টোকাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তার পাশেই দেখা মেলে পথশিশুদের। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবর্ণনীয় কষ্টে আছে তারা। পথের শিশু বলেই হয়ত তাদের দেখার কেউ নেই। এদের অধিকাংশই পরিবার থেকেত বিচ্ছিন্ন। বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও অনেকে জানে না তাদের বাবা-মা কে? তাদের কেউ কেউ বাবা অথবা মাকে চেনে। তবে বেশিরভাগই মায়ের সঙ্গে ফুটপাথ ওভারব্রিজ আন্ডারপাস কিংবা বস্তিতে থাকে। কারও কারও মাথার ওপর ছাউনি থাকে না। খোলা আকাশের নিচে তাদের বসবাস। ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগসহ ঢাকা শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দেখা মেলে এদের। তাদের কেউ কেউ ফুল বিক্রি করে। জীবনও একটু উন্নত। তবে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় আছে যারা টাকাই। এই টোকাইরা ডাস্টবিনের পাশেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায়। ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে সংগ্রহ করে পরিত্যক্ত ক্যান পানীয় বোতল কিংবা উচ্ছিষ্ট খাবার। তবে এ অংশের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। মহাখালী হয়ে ফার্মগেট ঢুকতে প্রথম যে ওভারব্রিজটি পড়ে তার নিচে বসে প্রকাশ্যে নেশার ঘোরে মশগুল ১০ থেকে ১৫ বছরের দুটি পথশিশু। মেয়ে ও ছেলে দুটি পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে গন্ধ শুঁকছিল বার বার। করছিল ভয়ঙ্কর নেশা ! গত ৬ ডিসেম্বর ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল সাড়ে দশটা। ফার্মগেট জিপি কাস্টমার কেয়ারের সম্মুখের ওভারব্রিজ। মেরামত কাজে তা এখন বন্ধ। তার পাশেই একটি পথশিশু ফুটপাথের একটি রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। মূলত এগুলো হচ্ছে তাদের জীবন ব্যবস্থা। নাগরিক জীবন থেকে ছিটকে পড়া এসব শিশু প্রতিনিয়ত নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। যৎসামান্য অর্থের লোভ দেখিয়ে এদের নানা অপরাধে লাগায় প্রভাবশালীরা। শান্তিনগর ফুটপাথে ভ্যানের ওপর পরিবারের সঙ্গে থাকে রতœা। রতœার স্বামী রিক্সা চালায়, রতœাও বাসাবাড়িতে কাজ করে। ফুটফুটে দুটি শিশু ঘুমাচ্ছিল ভ্যানের ওপর, রতœা সন্তান। আশামনি ও খুশি। রতœা জানায়, কষ্টের কথা বললেই কি আর মানুষের কানে পৌঁছায়! বলে খুব সমস্যা করে। যা জোটে তা দিয়েুু বাচ্চা দুটি নিয়ে রাস্তায় দিন কাটাচ্ছি। শকুর আলী, বয়স আনুমানিক ২। মায়ের সঙ্গে ফুটপাথে ভ্যানের ওপর বসবাস। নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা কাওরানবাজার, সেখানকার বিএসইসি ভবনের পাশে ফুটপাথে স্থান নিয়েছে সে। শুকুরের মা মনোয়ারা বলেন, পিচ্চিরে নিয়ে রাস্তায় থাকি, গরিব বইল্যাই আমাদের এই অবস্থা!‘ অন্য দশটি শিশুর মতো নয় ফালানও। কালি ময়লায় ঢাকা পড়েেেছ গায়ের রঙ। মা খুকির সঙ্গে কাওরান বাজারে ফুটপাথে ভ্যানেই থাকে। খুকি বলেন, ‘এখনও ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পারি নি, অথচ ওর বয়স পাঁচ হয়ে গেল।’ বিমানবন্দর রেলওয়ে ষ্টেশন। রোজ বৃহস্পতিবার ৪ ডিসেম্বর। ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। তিনটি পথশিশুকে দোড়াচ্ছে রেলের আনসার। বেত্রাঘাত খেয়েও অল্প কিছুদূর গিয়ে তাদের মুখে মুচকি হাসি। আবারও সেই আগের পন্থায়, ‘ভাই ২ডা টেহা দেন বা ‘ভাই খাইয়া বোতলডা দেইন’ কাছেই বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজ। তার ওপুেুুর শুয়ে শিশুটিকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন এক নারী। পাশে আরেক শিশু শীতে থরথর করে কাঁপছিল। মজিরন নামে ঐ নারী জানান, রাতে নানা ধরনের যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়। বাচ্চাদের শীত থেকে বাঁচানোর কাপড়চোপড় নেই। কমলাপুর রেল স্টেশনেও একই অবস্থা। রাতের অন্ধকার যত গভীর হয় ততই কষ্টের গভীরতা বাড়ে তাদের। সারাদেশে যখন হু হু করে শীতের তীব্রতা বাড়ছে, ক্রমর্বধমান হারে তাদেরও। দিন কয়েক আগে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় আরও করুণ চিত্র। স্টেশনের সম্মুখে দুটি শিশুসহ পুরো পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছিল। কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছিল তাদের গা। সংবাদকর্মীকে কাছে পেয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করছিল কিছু দেয়া হবে নাকি? শীতের কাপড় দেবেন? তাইলে নাম দিয়ে লাভ কি? তবে একটু ভিন্নচিত্রের দেখা মেলে এখানেই। স্টেশনের পশ্চিম-দক্ষিণের টঙ দোকান। দুটি পথশিশু, তারা বেশ চঞ্চল। একজনের নাম মুন্না, বাড়ি বগুড়ার সান্তাহার। অন্যজন শাওন, বাড়ি শরিয়তপুর। টঙ ঘরে বসে চা খাচ্ছিল দুই বন্ধু, তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে শিশু দুটি টাকা চাইল। কিন্তু টাকা না দিয়ে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলে একজন। মুর্হূতইে শিশু দুটির মুখে ফুটে উঠল অনাবিল হাসি। মহানন্দে বলতে থাকল, ‘আরেকটা তোলেন।’ পথশিশুদের মুখে এই নির্মল হাঁসি খুব কম সময়ই দেখা মেলে। পথশিশুদের নিয়ে বহু সংগঠন কাজ করলেও তেমন কোন চিন্তাও নেই কোন উর্ধতন মহল, মানবাধিকার সংগঠন কিংবা সরকারী-বেসরকারী এনজিও প্রতিষ্ঠানের। বলা যেতেই পারে, পথশিশুদের জীবনে বাবা থেকেও যেমন বাবা নেই, মা থেকেও যেমন মা নেই, তেমনি রাষ্ট্র থেকেও তাদের জন্য নেই রাষ্ট্র ! তাদের জীবন কি এভাবেই চলবে ? তাদের মুখে কি ফুটবে না সুখের হাসি ? পথশিশু বলেই কি পেতে পারে না কারও সহানুভূতি কিংবা রাষ্ট্রীয় সাহায্য
×