ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের মধ্যে আস্থা আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তি এসেছে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২ জানুয়ারি ২০১৫

মানুষের মধ্যে আস্থা আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তি এসেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমানে অর্থনীতিতে যে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই প্রমাণ করে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরা পুনরায় ক্ষমতায় এসেছি। আজকে দেশের মানুষের মধ্যে আস্থা, আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তি এসেছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় থাকায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছেছে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নেমে আসার কথা তুলে ধরে এই হার আরও ১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, আমরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আর ঘুরতে চাই না। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চাই। রফতানি বাড়াতে ব্যবসায়ীদের পূর্ণ উদ্যোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার ২০তম আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ‘অধিকতর উদারীকরণের মাধ্যমে’ যে সব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তাতে সম্ভাবনার পাশাপাশি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হয়েছে। উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পণ্যের মানোন্নয়ন ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। এ সময় শেখ হাসিনা তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর জন্য সড়ক, নৌ ও রেল তিন খাতেই গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যুত উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের রফতানির গড় প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানেই থামলে চলবে না; রফতানি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমানে আমরা ৭২৯টি পণ্য বিশ্বের ১৯২টি দেশে রফতানি করছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে আমাদের রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০.১৯ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ রফতানি তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে আমাদের রফতানির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ১৪ দশমিক ৯০ ভাগ। আমাদের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এই প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল ঈর্ষণীয়। চলতি অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে ‘এক হয়ে কাজ করার’ আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও উদ্যোগ সৃষ্টির তাগাদা দিয়ে তিনি বলেন, সকল সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দিচ্ছে সরকার। তবে আপনাদের (ব্যবসায়ী) সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই এবং আপনারা পূর্ণ উদ্যোগে কাজ করবেন- সেটা আমরা চাই। এ সময় বিশ্ব বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল কিছুর জন্য দরকার একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরা পুনরায় ক্ষমতায় এসেছি। আজকে দেশের মানুষের মধ্যে আস্থা, আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তি এসেছে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে স্বস্তির পরিবেশ রয়েছে মন্তব্য করে আগামীতে অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন বছরেও হতদরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়নে কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আমরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আর ঘুরতে চাই না। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কারও কাছে শুনতে চাই না বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে। ২০০৫ সালের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। আমরা তা ২৪ শতাংশে নেমে এনেছি। আরও ১০ ভাগ দারিদ্র্য হ্রাস করব। ৫ কোটি বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে ১ কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন সরকার প্রধান। তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। চীনের পরেই আমাদের স্থান। এই অবস্থানকে ধরে রাখতে হবে। নতুন বাজার খুঁজতে হবে, নতুন পণ্য রফতানিতে যোগ করতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রফতানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা আমি মনে করি এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। এ বছরের জন্য ওই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩.২ বিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্য পূরণে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিস্তর ফিরিস্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে মামলা করে সমুদ্র সমস্যা মিটিয়ে ফেলায় দেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি ব্লু-ইকোনোমি নামের একটি অনুষ্ঠান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মুদ্রাস্ফীতি আমরা সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে এসছি। গত নবেম্বরে সহনীয় ৬ দশমিক ২১ শতাংশ ছিল। মায়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের ফলে সমুদ্র-কেন্দ্রিক ব্লু-ইকোনমি সম্প্রসারণের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে আমাদের জিডিপি বেড়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ৬৩০ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২শ’ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে এক সময় অনেক বেশি চিন্তা হত। এখন আর রিজার্ভ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আজ পর্যন্ত বৈদেশিক রিজার্ভ রয়েছে ২২.৩৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার। দৈব দুর্বিপাকের জন্য সাধারণত তিন মাসের খাদ্য কেনার জন্য বৈদেশিক রিজার্ভ করা হয়। এখন আমাদের যে রিজার্ভ রয়েছে তাতে সাত মাসের খাদ্য কেনা যাবে। মাথাপ্রতি আয় ৬৩০ ডলার থেকে বেড়ে ১২০০ ডলারে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফিতি ডাবল ডিজিট থেকে ৬.২ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটে। তিনি আরও বলেন, এ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়াসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিরোধী দল বিএনপির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অতীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসে তারা এলিট শ্রেণী গড়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে দেয়নি। তারা যাতে আর কখনই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে না পারে তার জন্য সকলকে সজাগ থাকতে হবে। খুনের রাজত্ব আর বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায় না। তিনি বলেন, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশে বিরাজিত শান্তিপূর্ণ সহনশীল পরিবেশের কারণে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। যার সুফল দেশের জনগণ পাচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। কিন্তু এ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসে বিদ্যুত ও গ্যাসের উৎপাদন বন্ধ করে দেশের চাকা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমরা ক্ষমতায় এসে বিদ্যুত ও গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়ে এ সমস্যা সমাধান করেছি। পাশাপাশি সোলার এবং বায়োগ্যাস ইত্যাদি ব্যতিক্রম ব্যবস্থাসহ পাশাপাশি বিদ্যুত কেনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তা ও আস্থার উন্নতি হয়েছে। যে কোন দেশকে উন্নত করতে হলে চিন্তা ও আস্থার উন্নতি দরকার। যারা ত্যাগ করে সৃষ্টি করে। তারা কিন্তু সৃষ্টিকে ধ্বংস করে না। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ উন্নত হবে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখন জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনগণের কল্যাণে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে তারা ক্ষমতাকে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি বলে মনে করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জুলাই মাসের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক চার লেনে উন্নীত হবে। এই সড়ককে ভবিষ্যতে ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। রেল আর নৌপথে সস্তায় পণ্য পরিবহন করা যায়। সড়ক, রেল ও নৌপথের উন্নয়ন করে যোগাযোগের সমস্যা দূর করা হবে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজউল ইসলাম চৌধুরী, এফবিসিসিআইএ’র সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বোস।
×