ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৭ দফা ॥ কর্মীদের হতাশামুক্ত রাখার কৌশল

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২ জানুয়ারি ২০১৫

৭ দফা ॥ কর্মীদের হতাশামুক্ত রাখার কৌশল

শরীফুল ইসলাম ॥ সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে না পেরে দলের নেতাকর্মীদের হতাশামুক্ত রাখার কৌশল নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ কৌশলের অংশ হিসেবেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। জানা যায়, আগে কঠোর অবস্থানে থাকলেও সর্বশেষ দু’টি হরতাল কর্মসূচী ফ্লপ হওয়া এবং হরতাল চলাকালে কিছু নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার বিষয়টি দলীয় হাইকমান্ডকে ভাবনায় ফেলেছে। আর এ কারণেই একটু পিছু হটে আপাতত ইতিবাচক কর্মসূচী পালন করে পরে সময়-সুযোগমতো তারা আন্দোলনে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে। উল্লেখ্য, বিএনপি জোটের ডাকা ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে ও ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ফ্লপ হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হতাশ হন। তবে ২৯ ডিসেম্বর হরতাল শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শীঘ্রই পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণার আশ্বাস দিলেও দলীয় হাইকমান্ড মনে করছে আবারও আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়ে সফল না করা গেলে নেতাকর্মীরা আরও বেশি হতাশ হবে। সূত্র মতে, এ উপলব্ধি থেকেই খালেদা জিয়া কৌশল পরিবর্তন করে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ৭ দফা প্রস্তাব পেশ করে এ প্রস্তাব মানা না হলে সময়মতো কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা এবং সে আন্দোলনে তিনি নিজেও রাজপথে নেমে আসার কথা বলেছেন। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বুধবার সন্ধ্যায় তার গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন রাজনীতি কৌশলের খেলা। তাই বিএনপ্ওি সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিজস্ব কৌশলেই এগিয়ে যাচ্ছে। আরও কয়েকমাস আগে থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা হাঁকডাক দিয়ে বলেছিলেন বছরের শেষদিকে সরকার পতনের লক্ষ্যে কঠোর আন্দোলন শুরু করবেন তারা। আর এ আন্দোলনকে টার্গেট করে ডজনখানেক জেলায় জনসভাও করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে জনসভা করতে না দেয়ায় রাজনীতিতে বড় ধরনের হোঁচট খান তিনি। প্রথমে যে কোন মূল্যে জনসভা করার ঘোষণা দিয়েও বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে পরে তিনি পিছু হটে আসেন। তবে ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুর ও ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার টার্গেট নিলেও দলের নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে না নামায় জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতাকর্মীরাও এবারের হরতালে আগের মতো মাঠে নামেনি। সকালের দিকে কোন কোন এলাকায় জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে হরতালের পক্ষে ঝটিকা মিছিল করলেও পরে খোঁজখবর নিয়ে যখন জানতে পারেÑ বিএনপি নেতারা মাঠে নামেনি তখন তারাও রাজপথ ছেড়ে চলে যায়। আর সর্বস্তরের মানুষও হরতালকারীদের দুর্বলতার সুযোগে ঘর থেকে বের হয়ে এলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং বিএনপি জোটের হরতাল মাঠে মারা যায়। আর এ কারণেই খালেদা জিয়া জরুরী সংবাদ সম্মেলন ডেকে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচী না দিয়ে কৌশল পরিবর্তন করে সরকারের কাছে এমন একটি প্রস্তাব তুলে ধরেন যাতে নেতাকর্মীরা হতাশা কাটিয়ে আশাবাদী হতে পারে। সূত্র মতে, আন্দোলন কর্মসূচী না করার কৌশল হিসেবে খালেদা জিয়া যে বিষয়টি বিবেচনায় আনেন তা হলো হরতাল-সহিংসতা এখন আর জনগণ পছন্দ করছে না। এমনকি দলের নেতাকর্মীরাও আর ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামতে চান না। কারণ দলের অনেক নেতাকর্মীই এখন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। তারা হরতালে মাঠে নেমে দলের কর্মসূচী সফলের চেয়ে এখন ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এবারের হরতাল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই এটা বোঝা যায়। অবশ্য কর্মব্যস্ত মানুষ এখন আর আগের মতো হরতালসহ আন্দোলন কর্মসূচীকে ভয় পায় না। তাই মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে নির্ভয়ে ঘরে থেকে বের হয়ে আসে। আর উল্টো চিত্র দেখা যায় হরতালকারীদের মধ্যেই। হরতাল ডেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজেই বাসায় ঘুমিয়ে থাকেন। আর দলের অন্য সিনিয়র নেতারা যার যেখানে সুবিধা সেখানে বসেই নিজেদের ব্যবসাবাণিজ্য চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি টেলিভিশনে হরতাল পর্যবেক্ষণ করেন। আর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কিছু নেতা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এসি রুমে টেলিভিশনের সামনে বসে টেলিফোনে সারাদেশের হরতালের খোঁজখবর নেন। নেতাকর্মীরা ঘরে বসে সময় পার করায় এ ধরনের হরতাল এখন মানুষের কাছে, দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। একদিকে আন্দোলন কর্মসূচী পালনে ব্যর্থতা এবং অপরদিকে দলের সিনিয়র নেতাদের ভারসাম্যহীন বক্তব্যের পাশাপাশি সরকারের কঠোর মনোভাব বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশার মাত্রা দিনদিনই বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ তথ্য জানতে পেরেই আপাতত আন্দোলনের ব্যাপারে পিছুটান দিয়ে পরবর্তী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার ব্যাপারে সরকারকে চাপে রাখতে ৭ দফা প্রস্তাব দিয়ে একদিকে দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখা এবং অপরদিকে বিদেশী কূটনীতিকদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি লন্ডনপ্রবাসী বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে সারাদেশে নিন্দার ঝড় তোলেন। সর্বস্তরের মানুষ তারেক রহমানের এ বক্তব্যের নিন্দা জানাতে থাকে। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর ছাত্রলীগ ঘোষণা দেয় তারেক রহমান তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা না চাইলে খালেদা জিয়াকে গাজীপুরে জনসভা করতে দেয়া হবে না। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও খালেদা জিয়াকে তারেক রহমানের জিহ্বা সামলাতে বলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করার বিষয়ে ক্ষমা না চেয়ে যে কোন মূল্যে গাজীপুরে জনসভা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগও একইস্থানে একইদিনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর ফলে সেখানে আর জনসভা করতে পারেননি খালেদা জিয়া। আপাতত কঠোর আন্দোলনে না যাওয়ার ব্যাপারে অন্য যে বিষয়টিকে খালেদা জিয়া বিবেচনায় নিয়েছে তা হচ্ছে হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে কিছু বেপরোয়া নেতাকর্মী অতি উৎসাহী হয়ে নাশকতামূলক কর্মকা- করে ফেলে যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত দলীয় হাইকমান্ডের ওপর এসে পড়ে। এতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পরিবর্তে বিপরীতমুখী ইমেজ সৃষ্টি করে। সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বরের হরতালে একজন স্কুলশিক্ষিকা হত্যা ও বেশ ক’জনকে অগ্নিদগ্ধ করাসহ অসংখ্য যানবাহন ভাংচুর ও জ্বালাও পোড়াও করে বিএনপি জোট জনমনে ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার পর মানুষ বলাবলি করছে, হরতাল ডেকে যারা মাঠে নামে না কিন্তু নাশকতা চালিয়ে মানুষ হত্যা করে তাদের হরতাল কি উদ্দেশে? এ হরতাল জনগণের কি উপকারে আসে? এমন সমালোচনা চাঙ্গা হওয়ায় খালেদা জিয়া ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে সরকার বিরোধী আন্দোলনের হুমকি-ধমকির-কৌশল পরিবর্তন করে ৭ দফা ইতিবাচক একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি সরকারকে সংলাপের আহ্বানও জানান। জানা যায়, ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজ মাঠে জনসভা করতে না দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্তের পরই দলের কিছু নেতার পরামর্শে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা গাজীপুরে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিতে রাজি হন। কিন্তু যে নেতারা তাকে হরতালের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা নিজেরাই হরতাল সফলের ব্যাপারে তৎপর ছিলেন না। যে কারণে সেই হরতাল বিফল হয়। তার পরও খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা ধারাবাহিকভাবে বলতে থাকেন এ সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেয়া যায় না। তারা এ সরকারের পতন ঘটাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। এবং পরবর্তী কর্মসূচীতে খালেদা জিয়া নিজেও রাস্তায় নামবেন বলে ঘোষণা দেন। খালেদা জিয়ার এ ঘোষণা নেতাকর্মীদের ২৯ তারিখের হরতালে মাঠে নামানোর ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টির কৌশল ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু ২৯ তারিখের হরতালেও যখন বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নামলেন না এমনকি জামায়াতের নেতাকর্মীরাও আগের মতো সাড়া দিলেন না তখনই খালেদা জিয়ার টনক নড়ে। এ কারণেই তিনি ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে কৌশল পরিবর্তন করে আন্দোলনের পরিবর্তে ৭ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব কিছু কৌশল থাকে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা না করে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ৭ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। সরকার এ প্রস্তাবকে গুরুত্ব না দিলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যথাসময়ে আন্দোলন করেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর নির্বাচনের জন্যই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। যদি সরকার এ প্রস্তাব মেনে নেয় তা হলেও তা আর আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। আর যদি তা মেনে না নেয় তখন আমরা আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করব।
×