ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বছরজুড়ে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ জানুয়ারি ২০১৫

বছরজুড়ে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিদায়ী একটি বছরে রাজনীতির সফলতা-ব্যর্থতার খেরোখাতা খুলে বসেছে অনেকেই। আর সেই খেরোখাতায় যে লাইনটি সর্বাগ্রে উঠে এসেছে তা হচ্ছেÑ বিদায়ী ২০১৪ সালের একটি বছর রাজনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। আর নির্বাচন বর্জনের ভুল রাজনীতি ও অতিমাত্রায় জামায়াত নির্ভরতায় ব্যর্থতার খাদের কিনারে বিএনপি এবং দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া। বিদায়ী একটি বছরে তৃতীয় রাজনৈতিক পক্ষের উত্থান কিংবা তৎপরতা দেখতে পায়নি দেশের মানুষ। ‘সমাজের দর্পণ’- সুশীল সমাজকে এমন বিশেষণে ভূষিত হলেও বাংলাদেশের তথাকথিত কিছু সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গের সুযোগসন্ধানী ও স্বার্থপর ভূমিকায় দেশবাসী কিছু সময়ে বিভ্রান্ত হলেও সামগ্রিক রাজনীতিতে তার কোনই প্রভাব ফেলতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই বিদায়ী বছরে নিশ্চিত অসাংবিধানিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাঙালী জাতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় জীবনে ও রাজনীতির ইতিহাসে এক অভিনব অধ্যায়ের যোগ হয় বিদায়ী বছর ২০১৪ সালে। গণতন্ত্রকে হত্যা করে অসাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার যে সুগভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল বিদায়ী বছরের শুরুতে সেই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আর ভয়াল নাশকতার পথ পেরিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নবযাত্রার শুভ সূচনা আর জনমনে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল ২০১৪ সাল। আর এ সাফল্যের অগ্রসেনানী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত ষড়যন্ত্রের কুহেলিকা ছিন্ন করে সাহসী নেতৃত্ব ও পদক্ষেপে দেশের মানুষ ভয়াল সহিংসতার পথ মাড়িয়েই ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিশ্চিত দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা ও অসাংবিধানিক শাসনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল বাংলাদেশকে। রাজনীতির সফলতা ও ব্যর্থতার বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু বিদায়ী বছর ২০১৪ সালেই নয়, তার আগের বছর ২০১৩ সালের ৫ মে সরকার উৎখাতে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের ষড়যন্ত্র ও নীলনক্সা ব্যর্থ করার মাধ্যমেই পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। এরপর থেকে বিদায়ী বছরের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত কিংবা হেফাজতীরা। কঠোর দমননীতির পরিবর্তে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিলে শামিল করে, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও পুরস্কার অর্জন এবং দেশের অর্থনীতিকে অতীতের সকল সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াতসহ কথিত বুদ্ধিজীবীদের সকল ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াত জোটকে বছর জুড়ে দমিয়ে রাখতেও সক্ষম হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে কার্যত অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। অন্যদিকে, পুরো একটি বছরই ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি বিদায়ী বছরের প্রথমে বাংলাদেশকে একটি ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ, মৃত্যুদীর্ণ, আগুনে পোড়া ও বোমায় বিধ্বস্ত শোকাতুর জনপদে পরিণত করেছিল। লক্ষ্য ছিল একটাই, যেকোন মূল্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা। এ লক্ষ্যে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশজুড়ে অভাবনীয় সহিংসতা চালায়। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে তারা ব্যর্থ হয়। ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রপ্রিয় দেশের মানুষ সকল নাশকতাকে উপেক্ষা করে ভোট দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সরকারকে। বিএনপি নেত্রীর ধারণা ছিল নির্বাচন হলেও সহিংস আন্দোলনের তা-বে ক্ষমতাসীন সরকার এক সপ্তাহ টিকে থাকতে পারবে না। আর এ লক্ষ্যে থেকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তা-ব চালিয়ে যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ রাজনৈতিক কৌশলের কাছে এখানেও বড় ধরনের পরাজয় ঘটে বিএনপি-জামায়াত জোটের। নির্বাচন শেষ হলেও নির্বাচন প্রতিরোধের নামে শুরু হওয়া তা-ব থামতে সময় লেগেছে। নির্বাচনের পরও বিএনপি-জামায়াতের তা-বের শিকার হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে সেনা-পুলিশ-র‌্যাবসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু বিদায়ী বছরের ১২ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজে হাত দেন। তাঁর দক্ষ ও সুচারু পরিকল্পনার কারণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে আন্দোলনে ভাটা পড়ে। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, মেধা, মনন ও সাহসী পদক্ষেপের কারণে ধীরে ধীরে পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। খালেদা জিয়ার পরিবর্তে বিরোধী দলের নেত্রীর আসনে বসেন জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ। জনসমর্থন, ১৪ দলীয় জোটের সাংগঠনিক শক্তি আর বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির পূর্ণ সমর্থন অর্জনের মাধ্যমে বছর জুড়েই বিএনপি-জামায়াতকে কার্যত গর্তে ঢুকিয়ে দিতেও সক্ষম হন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা। অন্যদিকে নির্বাচন বর্জনের মহাভুলেই বিদায়ী বছরে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট বছর জুড়ে আন্দোলনের হুমকি-ধমকি জারি রাখলেও রাজপথে কার্যত কোন আন্দোলন গড়ে তুলতেই ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ বিএনপি-জামায়াত জোট বছরটি পার করেছে বক্তৃতা-বিবৃতি আর আল্টিমেটাম দিয়ে। নতুন নির্বাচন আদায় তো দূরের কথা, সরকারের ওপর বিদায়ী একটি বছরে সামান্য চাপ তৈরিতেও ব্যর্থ হয়। রাজপথে আন্দোলনের নানা সময়সীমার কথা ঘোষণা করা হলেও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিই এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। আন্দোলন পরের কথা, আন্দোলনের মতো শক্তি অর্জনে বিদায়ী একটি বছরে হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে দল গোছাতেও ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। বিশ্লেষকদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে অস্বস্তি ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষভাবে কূটনৈতিক তৎপরতায় তা সামাল দিতে সক্ষম হন। সরকার গঠনের পর চীন, জাপান, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সফরের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট অস্বস্তি দূর করে দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন আদায়েও সক্ষম হন। বিশ্ববাসীকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে অপরিহার্য ছিল, তা বোঝাতেও সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী আর তার ফলাফলও হাতেনাতে পান তিনি। মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত প্রত্যক্ষ ভোটে বিশ্বের দুটি শীর্ষ সংসদীয় প্রতিষ্ঠান সিপিএ ও আইপিইউর দুই শীর্ষ পদে বাংলাদেশের দুইজন প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করানোর মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃত্বের বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থার প্রমাণ করতেও সক্ষম হন শেখ হাসিনা। শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, দেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মিছিলে শামিল করেও বিরোধী প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্র এক বছরেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। বিদায়ী বছরে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে রফতানিকারকদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম সংযোজন, সর্বোচ্চ সাত হাজার ৪১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি, মিয়ানমারের পর ভারতের সঙ্গেও আন্তর্জাতিক আদালতে আইনী লড়াই চালিয়ে সমুদ্রসীমায় বিশাল অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের কর্তৃত্ব স্থাপন, বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা, তথ্যপ্রযুক্তির চমকসৃষ্টির বিকাশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পুরো দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস ও সমর্থন আদায়েও সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী। আর এই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ফিরিস্তির বাস্তবতা থেকেই বিদায়ী একটি বছরে বিএনপি-জামায়াত জোট যুতসই কোন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে পারেনি, নামলেও জনগণের সামান্য সমর্থন পায়নি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ব্যতিরেকে বিদায়ী তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির তৎপরতাও দেখতে পারেনি দেশের মানুষ। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ কিছু নেতা ও ব্যক্তি দ্বি-দলীয় রাজনীতির বিপরীতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের জন্য কিছু কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামলেও হালে পানি পায়নি। তবে দেশের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল সমাজ বলে পরিচিত কিছু ব্যক্তিবর্গের সুবিধাবাদী-স্বার্থান্বেষী তৎপরতা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। বিএনপি-জামায়াতের ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে মধ্যরাতের টকশোতে অংশ নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি পরিচয়দানকারী কিছু ব্যক্তি বা নেতা সরকারবিরোধী কথামালার ফুলঝুরি ছড়ালেও বিদায়ী একটি বছরে জনগণের মাধ্যমে তার সামান্য আঁচড় আঁকতেও ব্যর্থ হন। টকশো ছাড়াও ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন নিউজ পেপার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত কিছু অপপ্রচারে জনগণের মাঝে সামান্য সময়ের জন্য বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে পারলেও সরকার দক্ষ পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই বিভ্রান্ত দূর করতেও সক্ষম হয়। অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও বিশ্লেষকরা বিদায়ী বছরের ১২ মাসের রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ থেকে অকপটেই বলেছেন, বছর জুড়েই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণটা ছিল শেখ হাসিনার একক হাতে। বছর জুড়ে হুমকি-ধমকি দিলেও নিয়ন্ত্রণের সামান্য অংশীদার হতেও ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি, জামায়াত কিংবা নেপথ্যের মহলবিশেষ। নতুন বছরে দুই দলই একে অপরকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ঝুলিতে সরকার পরিচালনার সফলতার ভার এতই বেশি যে, নতুন বছরেও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তাঁরই হাতে থাকবে। বিএনপি বা দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া একটি বছর যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, নতুন বছরেও তাঁর পক্ষে রাজপথে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।
×