ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

“বাঁচা-মরার আন্দোলন”

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪

“বাঁচা-মরার আন্দোলন”

নির্দলীয় বলে ঘোষিত এবং বহুল পঠিত একটি দৈনিকের শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম ছিল, “বাঁচা-মরার আন্দোলন প্রস্তুতি বিএনপির।” বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য তৈরি হচ্ছে এটা তারা বহুদিন থেকেই জনগণকে জানাচ্ছে। গত দুটি ঈদের পর তারা আন্দোলনে নামবে একথা তারা জানিয়েছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি। এবার তারা ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নামবে এমন কথা জানিয়েছে। বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেছেন। জোটের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল আন্দোলন করবে সেটা তো স্বাভাবিক। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে এই যে ওই দৈনিকের ভাষ্য অনুযায়ী বিএনপির কিছু কিছু নেতা এই আন্দোলনকে “হয় এসপার নয় ওসপার” বলে বর্ণনা করেছেন। এইসব নেতা বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন কিনা জানি না। “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক” এইসব নেতার ভাষ্য কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা ও আমাদের জানা নেই। বিএনপির আন্দোলনে যাবার কারণ হচ্ছে, তারা ১৪ সালের জানুয়ারি ৫’র নির্বাচনকে অবৈধ মনে করে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী শতকরা ৫জন ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। বিএনপি মনে করে, অবৈধ সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। তারা একটা ভাল নির্বাচন চায়। ভাল নির্বাচন বলতে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বোঝায়। কোন কোন সময় তারা নির্বাচনের দাবি ও সরকার পতনের দাবিকে একাকার করে ফেলে। তারা আন্দোলন করবে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আন্দোলনটাকে “বাঁচা-মরার আন্দোলন” হতে হবে কেন? এই আন্দোলনকে “হয় এসপার নয় ওসপার” বলেই বা বর্ণনা করছেন কেন বিএনপি নেতারা! গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ নির্বাচন। নির্বাচনে কেউ জিতে আর কেউ হারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদি কোন দেশে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে সেখানে বিজয়ী দল পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকে। আর পরাজয় স্বীকার করে পরাজিত দল সে সময়টা বিরোধী দলে থাকে। এমনটাই হয়ে থাকে সব গণতান্ত্রিক দেশে। যেহেতু এক পক্ষকে পরাজিত হতেই হয় তাই পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে পরাজিত দল। বিজয়ী পক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করে আর বিরোধীদল গঠন করে ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সংসদে সরকারী ও বিরোধী দলের উপস্থিতিতে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে সবকিছু ঠিকভাবে হচ্ছে না। এর একটা কারণ পরাজয়কে আমরা সহজভাবে নিতে পারিনা। গত নির্বাচনকে কেউ কেউ নীতিবিগর্হিত বলে ঘোষণা করেছেন। নীতিবিগর্হিতের সংজ্ঞা বড্ড জটিল তাই আমরা সেদিকে যাব না। কেউ কেউ গত নির্বাচনকে অবৈধ বলে বর্ণনা করেছেন। কেন অবৈধ সেটা কেউ ব্যাখ্যা করেননি। একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনে সরকার নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সম্পূর্ণ বৈধ। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই এভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে। অবৈধতার প্রশ্ন এখানে আসে কোথা থেকে? কেউ কেউ বলেছেন, আওয়ামী লীগ তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছিল ১৯৯৬ সালে আর আজ তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিচ্ছে না। কথাটা হচ্ছে এখন ১৯৯৬ সাল নয়। আর তাই পরিস্থিতি বদলে গেছে। মাগুরার নির্বাচনের মতো কিছু ঘটেনি বর্তমান সরকারের আমলে। তাই একটা অনির্বাচিত সরকারের হাতে শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা নয়, দেশের সব ক্ষমতা তুলে দেবার কোন প্রয়োজন নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রেকর্ড সম্বন্ধে চিন্তা করা যাক। তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা আর সরকারের দৈনন্দিন কাজগুলো সমাধা করা। কিন্তু গত তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার সূর্যের নিচে এমন কাজ নেই যাতে তারা হাত দেয়নি। দুই নেত্রীকে তারা দেশান্তরিত করার চেষ্টা করেছে। নির্যাতনে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে বেশ কিছু তরুণ। হাজার মানুষ কারাবরণ করেছে। দুই বছর তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকেছে। আর সংবিধান এমন ছিল যে যেকোন ব্যক্তিকে সরকার প্রধান নিযুক্ত করা যেত একটু চালাকি করেই। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের নিযুক্তি এমনিভাবে ঘটেছিল। বিরোধী দল বিএনপি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। তাদের দাবি ছিল তাদের পছন্দ মতো প্রথায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সেটা সরকার করেনি। প্রশ্নটা হচ্ছে এই যে তাদের কথামতো সব কাজ সরকারকে করতে হবে কেন। তারা আন্দোলনে নেমেছে। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে সরকারকে ক্ষমতা থেকে দূর করা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত। মনে হয়েছে তারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গত আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। প্রাণহানি হয়েছে ৫০০-এর উপর। বার্ন ইউনিটের ভয়াবহ দৃশ্য যারা দেখেছে তারা সে দৃশ্য কোনদিন ভুলতে পারবে না । বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ সরকারের প্রকাশ করা উচিত। গণতন্ত্রে সহ্যশক্তির প্রয়োজন। প্রয়োজন নমনীয়তার। প্রয়োজন শালীনতার। তাই শালীন ভাষা অপরিহার্য গণতন্ত্রে। রাজনীতিতে ভুলত্রুটি হতেই পারে। গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি ভুল করেছে। এই ভুল থেকে তারা শিক্ষালাভ করে তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এটাই আমরা আশা করি। আর তা না করে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, সামনের আন্দোলনে পরাজিত হলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না এমনি সব কথা বলে যারা বিএনপিকে ধ্বংসের পথে যেতে উৎসাহিত করছে তারা বিএনপির বন্ধু নয়। গণতন্ত্রে পরাজয় আছে। কিন্তু আছে আত্মসমালোচনা দ্বারা নিজেকে সংগঠিত করে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে বহু বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর কোন কোন দল আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে নির্বাচনে জিতে। ব্রিটিশ লেবার পার্টি ১৭ বছর বিরোধী দলে থাকার পর ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। কেউ কেউ ক্ষমতায় এসে ক্ষমতার সুবিধা গ্রহণ করতে চায়। তারা তাড়াতাড়ি ক্ষমতা চায় । গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে তা যদি সম্ভব হয় ভাল। তবে রক্তাক্ত পথে নামলে ঝুঁকি নিতে হয় বড় আকারের। ১৩ সালের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার অনেক কিছু আছে বিএনপির। সেটা তারা শিখেছে কি? তাদের দেখতে হবে মানুষ কি চায়? মানুষ কি আন্দোলন চায়? মনে তো হয় যে রক্তাক্ত আন্দোলন থেমে যাওয়ায় তারা নিশ্চিন্তে আছে। গ্রামের বাজারগুলো ঘুরে দেখুন। সেখানে মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত গল্পগুজব করে কাটাচ্ছে। তারা যে আন্দোলন করার জন্য ব্যগ্র তা মনে হয়কি? নিজের দল ও জোট বড় আকারের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত কি? খোদ রাজধানীতে সংগঠনের অবস্থা কি? ছাত্রদলের অবস্থা কি? পদবঞ্চিত ছাত্রদলের নেতাদের গোঁজামিল দিয়ে খুশি করা যাবে কি? এমনি অনেক প্রশ্নের জবাব পাবার আগে কোন বড় সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে কি ? বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু আওয়ামী লীগ আর বিএনপির রাজনীতি নয়, যদিও ভাসাভাসাভাবে তাই মনে হয়। আমদের ভেবে দেখতে হবে আড়াল থেকে কেউ কি আমাদের এমনটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে? একবার এ দল পরেরবার ও দল সরকারে। কেউ কি এমন অবস্থা জিইয়ে রাখতে চায় যাতে করে আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না পারে। আর তার ফলে তারা অগণতান্ত্রিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। দুই প্রধান দলের মধ্যে রেষারেষির তীব্রতা কি কোন অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সাহায্য করছে? এসব প্রশ্ন শুধু জনসাধারণকে নয় রাজনৈতিক দলগুলোকেই ভেবে দেখতে হবে। লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
×