ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

জীবনবিরোধী দুর্ভিক্ষ চাই না

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪

জীবনবিরোধী দুর্ভিক্ষ চাই না

সংসদ ভবনে ভিসুয়াল, ইমোশনাল, স্ট্রাকচারাল এবং সেনসরি অভিজ্ঞতা একত্র হয়েছে। এসব হচ্ছে বিরাট স্থাপত্যের হৃৎকেন্দ্র। সংসদ ভবনের স্পেসের মধ্যে দাঁড়িয়ে, ভবনটির শক্তি ও সুন্দরের প্রতি সাড়া দিতেই হয়। লুই কান যার সূত্রপাত করেছেন তার শেষ কারা করবেন? স্থপতির র‌্যাডিক্যাল ভিসুয়াল ভাষার পরিবৃদ্ধি জরুরী হয়ে পড়েছে। এই ভাষার পরিবৃদ্ধি যদি না হয়, তাহলে, এক সময় এই ভবনটি মুখ থুবড়ে পড়বে। এই ধরনের ভবিষ্যত থেকে ভবনটিকে রক্ষা করতে পারেন একদিকে একদল র‌্যাডিক্যাল স্থপতি এবং অন্যদিকে একজন স্বাপ্নিক স্পীকার ও এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসেন একঝাঁক আইন প্রণেতা। তাহলেই সংসদ ভবনের পূর্ণউদ্ভাবন ঘটবে। আমরা সেই সুদিনের আশায় চোখ মেলে আছি। স্থপতি এবং আইন প্রণেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে তৈরি হবে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নতুন ফর্ম, আমরা দেখব কিভাবে শিল্পীরা আইন প্রণেতাদের শিল্পের ক্ষেত্রে উজ্জীবিত করেছেন এবং আইন প্রণেতারা শিল্পী হয়ে উঠেছেন। দু’পক্ষই শিল্পী ও বাস্তববাদী, দু’পক্ষই শিল্প ও জীবনযাপনকে সম্ভাব্যপরতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। দু’পক্ষই রিস্ক নিতে প্রস্তুত হয়েছেন। কোন এক সময় আমরা বলতে পারব: মহান স্থপতিরা ও আইন প্রণেতারা, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, আর্টিস্ট। লুই কান আধুনিক স্থাপত্য আন্দোলন বাংলাদেশে এনেছেন। এই আধুনিকতার মুখ্য চক্রে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন লে কুর্বে, ঐতিহাসিক স্পিফ্রীডগিডিওন, এবং হানস আর্ক, কন্সটানটাইন ব্লাকুসি ও লেগেরের মতো শিল্পীরা। আবার এই আধুুনিকতাকে বাংলাদেশে এনেছেন লুই কান এবং মাযহারুল ইসলাম ও তাঁর ছাত্ররা। তাঁদের অর্গানিক এবস্ট্রাকশন প্রভাবিত করেছে মাযহারুল ইসলামের ফর্মের ব্যবহার। এভাবেই স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক স্টাইল বাংলাদেশে দানা বেঁধেছে। লুই কান এবং মাযহারুল ইসলামের কাজ বাস্তবে কি অভিনব স্টাইল তৈরি করেছে তা বোঝা সম্ভব নয় যদি না এসব ভবন চোখে দেখা যায় কিংবা এসব ভবন ব্যবহার করা যায় অথবা এসব ভবনে বাস করা যায়। তাদের কাজের প্রতারক সরলতা হচ্ছে এক ধরনের সফিসটিকেটেড সিনথেসিক, মনুমেন্টাল ও পপুলার, সাধারণ ও বিশেষ, বাস্তব ও মিথিক, প্রকৃতি ও শিল্পের বোঝাপড়া। তাদের ভবনগুলির এক ধরনের ইমোশনাল জাঁকালো ভাব আছে ও সেনসুয়াক অ্যাপিল আছে তাদের দক্ষ ধারণার পরপারে। ঢাকায় এখন যে সব ভবন নির্মিত হচ্ছে তাদের বোঝার অভিজ্ঞতা আমাদের হওয়া শুরু করেছে এই দুই শিল্পীর কাজ দেখে। তাঁরা দুজন আমাদের আধুনিক স্থাপত্যের কাছে হাত ধরে নিয়ে গেছেন এবং এই মুহূর্তের স্থপতিরা ঢাকার সর্বত্র আধুনিক ভবনের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এভাবে ইতিহাস থেকে ইতিহাসে আমরা যাত্রা করেছি। লুই কানের হাত ধরে ও মাযহারুল ইসলামের হাত ধরে আমরা আধুনিক স্থাপত্যের সাহস ও সুন্দরের মুখোমুখি হয়েছি। এখন সময় এসেছে লুই কান ও মাযহারুল ইসলামকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। শিরীন শারমিন চৌধুরী ও আইন প্রণেতাগণ কি আমাদের স্থাপত্যের নতুন ফর্ম পাঠ করতে শেখাবেন, যেমন করে মাযহারুল ইসলামের ছাত্ররা ঢাকা শহরকে স্থাপত্যের নতুন আর্ট ফর্মে বদলে দিতে শুরু করেছেন। ঢাকা শহরের নতুন ভবনগুলি কনট্রোলড, রিফাইনড এলিগ্যান্সের এপিটোম হয়ে উঠেছে। চতুর্দিকে সেøন্ডার টাওয়ার ডানা মেলছে। টাওয়ারগুলি রাস্তা থেকে আকাশের দিকে উঠেছে, কখনো দুটি টাওয়ার নিওন লাইটের দুটি কলাম তৈরি করেছে, এসব রং ড্রামাটিক, ভবনগুলির ফর্ম ও স্টাইল জাঁকালো। সংসদ ভবন আধুনিক রাজনীতির হৃৎকেন্দ্র হয়ে উঠুক, তেমন কি-না ঢাকা শহর আধুনিকতার হৃৎকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আপত্তি করবেন আমার এমন ধরনের উক্তিতে। আমরা যদি আধুনিক ভবন ঢাকা শহরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে আমরা কেন আমাদের রাজনীতিকে আধুনিক করতে পারব না। রাজনৈতিক বিপ্লবের সমান্তরালে নান্দনিক বিপ্লব আসা জরুরী। এই বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছেন জয়নুল আবেদিন। নান্দনিক বিপ্লব না আসার দরুন, কিংবা নান্দনিক বিপ্লব পিছিয়ে পড়ার দরুন রাজনৈতিক বিপ্লবের বীভৎসতা আমাদের ঘিরে ধরেছে। সেজন্য কি রুচির দুুর্ভিক্ষের কথা বারবার জয়নুল আবেদিন বলেছেন। শিল্পীরা ও সমাজ যদি পাশাপাশি না চলে, অথবা একই লক্ষ্যে যদি না অগ্রসর হয়, তাহলে রাজনীতির র‌্যাডিক্যাল মাধ্যমগুলি ভ্রষ্ট হয়ে যায়। তাই কি আমরা দেখছি না এখন এই দেশে। ঢাকা ইতিহাসের শহর, ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায়, পাড়ায়, রাস্তায় ইতিহাসের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ইতিহাসকে হত্যা করে শহর তৈরি করা যায় না। ইতিহাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব শহরবাসীর। আমি মোগল আমল থেকে এই শহরের বাসিন্দা, আমি ইংরেজ আমল থেকে এই শহরের বাসিন্দা, আমি স্বাধীন বাংলাদেশে এই শহরের বাসিন্দা। আমি এভাবে এই শহরে বড়ো হয়েছি। বড়ো হওয়ার অর্থ ইতিহাসের হাত ধরে বিভিন্ন আমলে পরিব্রাজনা করি। এই হচ্ছে আমার ঐতিহ্য, আমার সংস্কৃতি, আমার ইতিহাস। এখান থেকে আমাকে সরানো যায় না, সরানো যাবে না। সরানোর চেষ্টা হলে জীবনযাপনের রুচি নষ্ট হয়ে যায়। জয়নুল আবেদিন এই প্রচেষ্টাকে বলেছেন রুচির দুর্ভিক্ষ। লালবাগ কেল্লা একটা আইকনিক ইমেজ। কার্জন হল একটা আইকনিক ইমেজ। সংসদ ভবন একটা আইকনিক ইমেজ। এই সব ইমেজ স্থানচ্যুত করা যায় না। ঢাকা শহরের স্কাইলাইন এভাবে তৈরি করব, এই স্কাইলাইন আমার মধ্যে তৈরি করে একটা শক্তিশালী ভিস্যুয়াল ও ইমোশনাল প্রতিক্রিয়া : আমি ইতিহাসের মধ্যে বেঁচে আছি। স্মৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের গুরুত্ব এখানেই। গাছপালা, বৃক্ষ, আকাশ, তরু ভবনগুলিকে শিল্পসম্মত করে তোলে। সে কারণে ভবনগুলির একটা প্রতীকী দিক আছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা হলে এই আইকনিক ইমেজ নষ্ট হয়ে যায়। আকাশ, তরু, বৃক্ষ, গাছপালা, পায়ের নিচে মাইল মাইল সবুজ ঘাস নষ্ট করে আমরা কি অর্জন করব? নিজেদের নষ্ট করে আমরা কি পাব? রমনা পার্ক-সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের কোনার মসজিদ কি আমাদের অভিসম্পাত দেবে না? আমরা জীবনবিরোধী দুর্ভিক্ষ আর চাই না।
×