ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন, শিল্পাচার্যের স্বপ্ন আবেগ

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন, শিল্পাচার্যের স্বপ্ন আবেগ

মোরসালিন মিজান ॥ তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার/ বসি বাতায়নে/ সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি/ ভেবে দেখো মনে-/ একদিন শতবর্ষ আগে...। হ্যাঁ, আজ থেকে ঠিক শতবর্ষ আগে ফুটেছিল আলো। অত্যুজ্জ্বল সেই আলোর নাম জয়নুল আবেদিন। আজ ২৯ ডিসেম্বর সোমবার আশ্চর্য প্রতিভার শততম জন্মবার্ষিকী। বড়সড় উপলক্ষ। গোটা বছরেই চলছিল উৎসব অনুষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় চারুকলা অনুষদের লিচু তলায় বসেছে জয়নুল মেলা। বেশ কিছু স্টল। বাংলার লোক ও কারুশিল্প নিয়ে শিল্পাচার্যের যে স্বপ্ন, হৃদয়ের যত আবেগ, নানা ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হচ্ছে এখানে। রবিবার মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, দারুণ উৎসবের আমেজ। চারুকলার মূল ফটক থেকেই শুরু হয়ে গেছে সাজসজ্জা। বহিরাঙ্গন এত শিল্পীত আর পরিপাটি যে, মূল রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া সাধারণ পথিককেও কৌতূহলী করে তোলে। ভেতরে নিয়ে যায়। আর তখন মুগ্ধতা বেড়ে যেন দ্বিগুণ হয়। মেলার মূল আয়োজন লিচুতলায় হলেও, গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দ। বিভিন্ন বয়সী মানুষ দল বেঁধে ঘুরছেন। আড্ডা গল্প হচ্ছে। চলছে হৈহুল্লোড়। প্রথমেই চোখে পড়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী টেপা পুতুল। বিখ্যাত এই ফোক মোটিফ নিয়ে বাঁশের কাঠামো গড়া হয়েছে। মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন চারু ও কারু শিল্পীরা। হরেক রকমের পণ্য দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন তাঁরা। একাধিক স্টলে সিলেটের শীতলপাটি। খুবই প্রসিদ্ধ হওয়ায় সকলেই হাত দিয়ে অনুভব করছিলেন, কত নরম আর আরামদায়ক। হবিগঞ্জের গীতেস চন্দ্র দাস নিজে পাটি বুনে নিয়ে এসেছেন। গুটিয়ে রেখেছিলেন স্টলের এক কোণে। খোলার পর সত্যি চোখ ছানাভরা! জমিনের পুরোটাতে কাজ। হাতি, ফুল, লখি, কুলা, পালকি ইত্যাদির নকশা করা। দেখেই বোঝা যায়, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির কোথায় বিশেষত্ব। এর পরও কারও কারও মনে হতে পারে, এই শীতে শীতলপাটি দিয়ে কী হবে! বাস্তবতা হচ্ছে এগুলো শুধু শীতলপাটি নয়, অনবদ্য শিল্পকর্ম। বিশেষ উদ্যোগী হলে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা যায়। তখন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সমন্বয় আরও মূল্যবান করে তুলে শীতলপাটিকে। অবশ্য গীতেসদের মূল্য বাড়েনি। বাড়ে না। দুঃখ করে এই কারিগর বললেন, একটি শীতলপাটি তৈরি করতে এক মাস সময় লাগে। অথচ লোকে দাম দিতে চান না। পাটির দাম যা, তাতে দিনে এক শ’ টাকাও পাওয়া হয় না। পাশেই স্টল সাজিয়েছিলেন আরেক কারিগর অরুণ চন্দ্র দাস। বললেন, সারাদেশে এই শীতলপাটি তৈরির কারিগর আছে মাত্র ৫ থেকে ৭ জন। অথচ সরকারী কোন পৃষ্ঠপোষকতা আমরা পাই না। এভাবে চললে শিল্পটি আর কিছু দিনের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তাঁর। নকশী কাঁথা দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের হোসনে আরা। তাঁর সূচি শিল্প দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। প্রতিটি কাঁথার গায়ে ফুল লতাপাতা পাখির নকশা। সুঁই সুতা দিয়ে যেন কাব্য করেছেন সূচিশিল্পী। এ স্টলে নকশী কাঁথা ছাড়াও আছে শাড়ি, থ্রি প্রিস। কাঁসা ও পিতলে অতটা পারা যায় না। বেশ দুরূহ কাজ। তবে এক সময় এ মাধ্যমটি তুমুল জনপ্রিয় ছিল। নৈপুণ্য দেখিয়েছে। এর কিছু খুঁজে পাওয়া গেল ঢাকার অনিক সরকারের স্টলে। সময় বদলে যাওয়ায় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী কমেছে। তবে শোপিসের মতো করে গড়া দেবদেবীর নানা মূর্তি এখনও তুলে ধরছে হারানো গৌরব। রাধাকৃষ্ণ এখানে যেন প্রাণ পেয়েছে। আছে হাতের চুরি, চুলের কাঁটাও। সবই টিকে থাকার স্বার্থে। শাঁখা শিল্পের নিদর্শন নিয়ে মেলায় এসেছেন পুরান ঢাকার অনুপ নাগ। ছোটবেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে তিনি জড়িত। বাপ-দাদার পেশা তিনি আজও ধরে রেখেছেন। তাঁর স্টলে কারুকাজ করা শাঁখা। সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা শঙ্খ। এসবের গা কেটে চমৎকার সব শিল্পকর্ম গড়া হয়েছে। শিল্পী বললেন, শাঁখারী বাজারের অধিকাংশই এখন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে আমদানি করে। আর আমি নিজে কারিগর। এ কারণে আমার কাজের আলাদা মূল্য। শোলা শিল্পীরাও স্টলে বসে সুন্দর কাজ করছিলেন। বিভিন্ন খেলনা তৈরি করছিলেন। পাশেই শাঁখেরহাঁড়ি সাজানো। কাঁচা রঙে আঁকা হাঁড়ি খুব সহজেই নজর কাড়ে। ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাদ যায়নি বাঁশের বাঁশি। হরেক রকমের বাঁশি নিয়ে এসেছেন ঝিনাইদহের কমল সরকার। মুখ বাঁশি আছে। আছে বিভিন্ন স্কেলের আঁড় বাঁশিও। কারিগর জানালেন, বংশপরম্পরায় তাঁরা বাঁশি তৈরি করে চলেছেন। রিলে রেসের কাঠি এখন তাঁর হাতে। একটি স্টল আবার হাতপাখা দিয়ে সাজানো। লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এসব নিদর্শন যেন জয়নুল আবেদিনের স্বপ্নের কথা বলছে। বলছে, পৃষ্ঠপোষকতা দাও। বাঁচিয়ে রাখ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের পাশাপাশি জয়নুল মেলায় স্টল সাজিয়েছে চারুকলা অনুষদের ৮ বিভাগ। এসব স্টলে চলছে ছাত্রছাত্রীদের গড়া শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। জয়নুলের শিল্পভাবনা ও দর্শন থেকে নিয়ে নিজেদের মতো করে কাজ করেছেন তাঁরা। মেলা ঘুরে বেড়ানো এবং কেনাকাটার সুযোগ থাকবে আজ সোমবার পর্যন্ত।
×