ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বড় বড় ক্রেতার মুখ ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি সত্ত্বেও বেড়েছে রফতানি ;###;বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, রফতানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে ২২ সাল পর্যন্ত

ঘুরে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্ট খাত বিদায়ী বছরে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪

ঘুরে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্ট খাত বিদায়ী বছরে

এম শাহজাহান ॥ রানা প্লাজা দুর্ঘটনাপরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিদায়ী বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্টস খাত। এখন তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ধীরে ধীরে গার্মেন্টস শিল্প সরিয়ে নেবে সরকার। এ কার্যক্রম শুরু হবে নতুন বছর থেকেই। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতে করা হবে গার্মেন্টস পল্লী। এছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণের পর দ্রুত শিপমেন্টে মংলা পোর্ট দিয়ে শুধু গার্মেন্টস পণ্য রফতানির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সরকার ঘোষিত ভিশন-২১ বাস্তবায়নে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির স্বপ্ন পূরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের কার্যক্রমও নতুন বছর থেকে পুরোদমে শুরু করবেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, গত বছরে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি স্থগিত ও ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন নিয়ে চাপে পড়েছিল পোশাক শিল্প খাত। এ শিল্প খাতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছিল। তবে সেই চ্যালেঞ্জ ও চাপ সামলে নিয়ে রফতানি বাণিজ্যের প্রাণ পোশাক শিল্প খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সরকার ও শিল্পমালিকদের বাস্তবমুখী পদক্ষেপে পোশাকের রফতানি বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে ভিশন-’২১ সামনে রেখে রফতানি বাণিজ্য ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। ওই সময়ের মধ্যে শুধু পোশাক শিল্পে আরও ২৯ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ শিল্পে এখন প্রতিবছর গড়ে ১৫-২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ২০ বছর নাগাদ এ শিল্পের গ্রোথ এ হারেই বাড়বে। এই গ্রোথ ধরে রাখার জন্য গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনসহ অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। সূত্রমতে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বড় ধরনের ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে পোশাক শিল্প খাত। বড় বড় ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি দেয়। তারপরও ওই বছরটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান-২০১৪ তথ্যমতে, গত ২০১৩ সালে বিশ্ব পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই সময়ে বার্ষিক রফতানি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ৩৫৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রফতানি বেড়েছে। এছাড়া ইপিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ওভেন রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। বেড়েছে নিট পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধিও। ওই সময়ে নিট রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। যদিও এর আগের দুই মাস ধরে পোশাক রফতানি সামান্য নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেছে। তবে অর্ডার বৃদ্ধি এবং নতুন বাজার সম্প্রসারণ হওয়ায় উদ্যোক্তারা আশা করছেন, বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। সূত্রমতে, বাংলাদেশের পোশাক তৈরির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ফলে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া কেউই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। এখন একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। কিন্তু চীন এখন ৪০ বছরের নিচে কোন শ্রমিক পাচ্ছে না গার্মেন্ট শিল্পে। সে কারণে চীনও প্রতিদ্বন্দ্বীর তালিকা থেকে সরে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যে সব পোশাক শিল্প পণ্য বিক্রি হয় তার ৪০ শতাংশই হচ্ছে বেসিক গার্মেন্টস। এই বেসিক গার্মেন্টসের চাহিদা সারাবিশ্বে প্রতিবছর বাড়ছে প্রায় ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলারের। আর বেসিক গার্মেন্টসের জন্য বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাজার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি জনকণ্ঠকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর সারাবিশ্বে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসছে পোশাক শিল্প খাত। সরকার ও মালিক পক্ষের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো এখন পোশাক প্রস্তুত ও রফতানি করছে। ফলে ছোট ছোট কারখানাগুলো সাময়িক অসুবিধায় পড়লেও বিশ্বে এ শিল্পের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধস ও তাজরিনে দুর্ঘটনার পর যেসব ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাঁরা এখন আবার ফিরে আসছেন। এখন দিনরাত কাজ হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পে। আশা করছি বছর শেষে রফতানির যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণ হবে। এদিকে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সম্প্রতি এ কথা বলা হয়েছে। এ আশাবাদের পেছনের যুক্তি, পোশাক কেনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত চীনের পর বাংলাদেশই হচ্ছে ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। কারণ এখানে শ্রমিকদের কম মজুরি, শ্রমিক প্রাচুর্য, কর্মদক্ষতা ও পণ্যের ভাল মান। এ তথ্যের সত্যতাও মিলছে। গত বছর এপ্রিল মাসে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ইমেজ সঙ্কটে পড়ে। তখন পোশাক রফতানি মুখ থুবড়ে পড়বেÑ এমন আশঙ্কাও ছিল। তবে পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে। পাশাপাশি নতুন বেশ কয়েকটি বাজারে পোশাক রফতানি বাড়ছে যা খুবই ইতিবাচক। ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে গার্মেন্টস শিল্প ॥ কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং যানজট মুক্ত রাজধানী গড়তে ধীরে ধীরে ঢাকা থেকে গার্মেন্টস শিল্প সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। এ প্রক্রিয়া শুরু হবে নতুন বছর থেকে। এতে রফতানিতে শীর্ষে থাকা এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে ২৫০টি কারখানা গড়ে তোলা হবে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের শান্তির চরে আরেকটি গার্মেন্টস পল্লী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এভাবে জেলা শহরের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার বাউশিয়ার মতো নারায়ণগঞ্জের শান্তির চরে এক হাজার একর জমির ওপর পোশাক পল্লী গড়ে তুলতে চায়। শুধু তাই নয়, পর্যায়ক্রমে ঢাকা শহর থেকে সরিয়ে এ শিল্প দেশের অন্যসব জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে নিয়ে যেতে হবে। এতে কারখানায় উন্নত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা যাবে। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হবে মংলা পোর্ট দিয়ে ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ব্যস্ততা দিন দিন বাড়ছে। আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যস্ততাও। কিন্তু দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। এ কারণে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর মংলা পোর্ট শুধু গার্মেন্টস পণ্য রফতানির জন্য ছেড়ে দেয়া হতে পারে। এ ধরনের একটি পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এছাড়া এ শিল্পের উদ্যোক্তারাও চায় একটি পৃথক সমুদ্রবন্দর শুধু গার্মেন্টস পণ্যের জন্য দেয়া হোক। সেই বিবেচনায় মংলা পোর্ট গার্মেন্টস পণ্য রফতানির জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার পরই এ উদ্যোগ কার্যকর করা হবে। বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান হবে ॥ বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, পোশাক শিল্প খাতের অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে এ শিল্পে ৬৯ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বর্তমান এ শিল্পে ৩০ লাখ নারী ও ১০ লাখ পুরুষ কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পোশাক শিল্প খাতসহ দেশের শ্রমঘন শিল্প খাতে দেড় কোটি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। একে কাজে লাগাতে ৫টি পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর ওপর ভিত্তি করে একটি কর্মকৌশল তৈরি করছে সরকার। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের দাম বাড়ায় চীন থেকে আগামী দশ বছরে ৮০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান বেরিয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা হিসাব করেছি বাংলাদেশে শ্রমঘন শিল্পে ১৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সম্ভব। কিন্তু এর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ দরকার। অবকাঠামো, জমি, দক্ষ শ্রমিক, অর্থায়ন ও জ্বালানি এগুলোর প্রয়োজন। জিএসপি স্থগিতের প্রভাব নেই ॥ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি স্থগিতে পোশাক রফতানিতে প্রভাব পড়েনি। বরং ওই সময়ে দেশটিকে পোশাক রফতানি বেড়েছে। এছাড়া নতুন বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে। জিএসপি ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যান নামে যে ১৬টি শর্ত দেয়া হয়েছিল তার অধিকাংশ শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা হচ্ছে পোশাক রফতানির প্রচলিত মার্কেট। এ ২৯টি মার্কেটের বাইরে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল, চিলি, পেরু, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনাসহ রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক, চীন, জাপান, কোরিয়া ও ভারত অপ্রচলিত মার্কেটগুলোর মধ্যে অন্যতম। আশার কথা হলো প্রচলিত মার্কেটের রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও অপ্রচলিত এ সব মার্কেটের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য পুরস্কার ॥ ভাল কর্মপরিবেশের জন্য এখন থেকে উদ্যোক্তাদের পুরস্কার দেয়া হবে। বাংলাদেশ সরকার ও জার্মানি যৌথভাবে এ পুরস্কার প্রদান প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে জার্মান সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থা জিআইজেড। এছাড়া এ শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কর্মক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিতকরণে নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করবে বিজিএমইএ। এছাড়া পোশাক খাতে অতিরিক্ত নগদ সহায়তা দেয়া হবে। সরকার ঘোষিত অতিরিক্ত নগদ সহায়তা তৈরি পোশাক খাতের সব রফতানিকারকই পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এ বিষয়ে এক নতুন নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠিয়েছে। এছাড়া পোশাক শিল্পের কর্মী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ শিল্পের জন্য দক্ষ শ্রমশক্তি গড়তে বেকার যুব ও যুব মহিলাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
×