ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পৃথিবীর মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪

পৃথিবীর মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ

স্বাধীনতার চার দশক পরে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনে বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগের মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই বলে মন্তব্য করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু। দ্য হিন্দুর মতামত পাতায় এ নিবন্ধটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক গার্গ চ্যাটার্জি। নিবন্ধে বলা হয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং আওয়ামী লীগ- যাদের ওপর বাংলাদেশের হিন্দুরা স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি আস্থা রেখে এসেছে- উভয়ের বর্তমান মানসিকতায় খুব বেশি তফাত নেই। নিবন্ধে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিতকরণের কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এ উপমহাদেশে আবেগী কথা দিয়ে অতীত ভোলানো রাজনীতির খুব চল থাকলেও, অন্তত এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে তাদের অতীতকে ভোলানো যায়নি। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনে জয়লাভের পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের খ—গ নৃশংসভাবে নেমে আসে। হিন্দুরা এ দেশে একরকম ঐতিহ্যগতভাবে তাদের জান এবং মাল রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখে, তাদের ভোট দিয়ে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলেও দেখা গেছে দলটির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সুযোগ পেলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, গবাদি পশু দখল করেছে, তাদের ওপর শোষণ নির্যাতন চালিয়েছে। যদিও ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগের মূলনীতিতে এ ধরনের শোষণের সমর্থন নেই। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপি জোটের মূলনীতি এবং কার্যপরিধি গণতন্ত্রের আগে বিধাতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার মানসিকতা রাখে, যেখানে হিন্দুরা তত্ত্বগতভাবেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। পত্রিকাটি উল্লেখ করে, গত কয়েক বছর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীগোষ্ঠী বিএনপি-জামায়াত জোট আর তথাকথিত সেক্যুলার দল আওয়ামী লীগের মাঝে মূলত কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের সেই সেক্যুলার আদর্শ, যে আদর্শ অনুযায়ী সারাদেশের সব ধর্মের মানুষ নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে নিশ্চিন্তে সবরকম সুবিধা সমানভাবে ভোগ করার অধিকার রাখত, সেই সেক্যুলারনীতি তোতাপাখির বুলির মতো আওড়াতে নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের এখনও কোন ক্লান্তি নেই। (ভোরের কাগজ : শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০১৪)। একাত্তরের অশ্রু-রক্ত-স্বেদসহ বিশাল ধন-সম্পত্তি-জীবন বলীদান করেও সংখ্যালঘুদের নারী-সম্পদ-মন্দির- সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার অর্জন হলো না। সামাজিক-রাজনৈতিক অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধ হলো না বাংলাদেশে। অর্পিত সম্পত্তি নামে দেবোত্তর সম্পত্তির অসাম্য আইনের অপপ্রয়োগ হিন্দুদের দেশান্তরের অন্যতম কারণ অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণায় স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও আইনের অসম অপপ্রয়োগ বন্ধ হলো না, দেবোত্তর আইন সৃজন করা হলো না। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নির্ণয়-চাকরির সুযোগ ভোগের যে রাজনৈতিক হাতিয়ার সৃষ্টি করা হচ্ছে তা শুভ নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান বা তাঁদের সন্তানদের কী কী সুযোগ-সুবিধা, চাকরি, আবাসন, জমি বরাদ্দ, চিকিৎসা, যাতায়াত ও সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে প্রাপ্য হবেন তা একবার মন্ত্রিপরিষদের সভায় আলোচনা করে সরকার সংসদে বিবৃতি দিয়ে নীতিমালা ঘোষণা করুন। বিশ্বের বহু দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধ সংগঠকদের সম্মান দিয়ে থাকেনÑ সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকোর্ট এক রিট আবেদনে সেসব দেশের উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধ সংগঠকদের কী সম্মান জাতি দিতে চায় তা মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সরকার সংসদে জানিয়ে দিন। রাজনীতির মঞ্চে এসব কথা বলা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক বলয় সৃজনের নামান্তর। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক বাহিনী শুধু বঙ্গবন্ধুর বিচার করেই ক্ষ্যান্ত ছিল না এছাড়া যাদের অনুপস্থিতিতে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ২১-৪-৭১ তারিখের ঢাকার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল), তোফায়েল আহমদ এবং দি পিপলস দৈনিকের সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬-৫-৭১ তারিখে ঢাকায় ১নং সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়েছিল এবং অনুপস্থিত ‘বিচার’-এ ১৪ বছর সশ্রম কারাদ- এবং অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র : ১৫-খ, পৃষ্ঠা-৪৫) নূর-ই-আলম সিদ্দিকীসহ প্রায় সব মিলিট্যান্ট যুব ছাত্রনেতা, আবু সাইদ চৌধুরী, এমএজি ওসমানী, ১৪ জন সিএসপি ও ২২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ৫৫ জন কর্মকর্তা এবং অধিকাংশ এমএনএ/এমপিএর অনুপস্থিতিতে পাক বাহিনী একই ধরনের বিচার ও শাস্তি প্রদান করেছিল। কিন্তু ২৭ মার্চ পাক বাহিনী যার কণ্ঠ বেতারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিল, স্বাধীনতার সেই কথিত ঘোষকের (মেজর জিয়া) বিরুদ্ধে এ ধরনের কোন সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধেও সংগঠক ও ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন ৮০-এর দশকে ডিআইটির একটি প্লটের জন্য দরখাস্ত জানালে প্রথমে তাঁকে একটি প্লট সাময়িক বরাদ্দ দেয়া হলেও তা ৪ কিস্তির মধ্যে ২ কিস্তি পরিশোধের পরও তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মার্ক কম অজুহাতে সে বরাদ্দ বাতিল করে দেয়। এ নিয়ে এক দশক টানা-হেঁচড়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই বিষয়টির সম্মানজনক সুরাহা হয়, কিন্তু মাখন তা দেখে যেতে পারেননি। খেতাবপ্রাপ্ত নিয়ে প্রচারের অন্ত নেই প্রথম আলো পত্রিকা প্রায় দু’বছর ধরে ‘আমাদের এ ঋণ শোধ হবে না’ শিরোনামে ধারাবাহিক ছাপছে প্রায় ৬ শতাধিক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম, পরিচয় এবং কাহিনী এতে ধারণাটি আরও পোক্ত হবে যে এরাই দেশ স্বাধীন করেছে কিন্তু সংগঠকদের কীর্তি থাকছে অনুচ্চারিত। (সরদার সিরাজুল ইসলাম, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১-১২-১২)। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার জন্য আন্দোলন করে সচিবালয়ের গেটে মরতে হয়। একজন অসুস্থ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিবকে প্রধানমন্ত্রী অফিসের এ্যাপয়েন্ট নিয়েও ৩ ঘণ্টা গণভবনের গেটে অবস্থান করেও আবাসন ও চিকিৎসার জটিলতাজনিত সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত পান না। ভাতা ২০০০ থেকে ৩০০০ হাজার আবার ৩০০০ থেকে ৫০০০ হাজার এখন শোনা যাচ্ছে। আগামী বাজেটে ১০,০০০ টাকা হবে, কিন্তু কেন? জাতীয় পে-কমিশন গঠন হয়েছে সকল কর্মচারীদের (অবসর গ্রহণকারীসহ) বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি পাবে স্বাভাবিকভাবে হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও বাড়িভাড়া দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি সঙ্গে জড়িত। জাতীয় পে-কমিশনের সুপারিশের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও বাড়িভাড়া দেয়া হবে না কেন? একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা শরণার্থী জীবনের অশ্রু-রক্ত-মৃত্যুর সাগর পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশের’ নাগরিক হিসেবে ফিরে এসেছিলাম। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার অর্থ ছিল পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের সমাধি রচনা করে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেক্যুলার বাংলাদেশে’ ফিরে আসা। পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে অস্বীকার করেছে বলেই পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিকামী বাঙালী শরণার্থী অমুসলিম জনগোষ্ঠী নাগরিকগণের কাছে অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ ছিল ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। স্বাধীন বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ ছিল গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে সমানাধিকারের ভিত্তিতে সুস্থ ও সম্মানজনক জীবনযাপন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম আদর্শ হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সংযোজন ছিল সেই আদর্শেরই স্বীকৃতি। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই ত্রিশ লাখ শহীদ, কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধার নিবেদিত দেশপ্রেম ও এক কোটি বাঙালী শরণার্থীর অশ্রু-রক্ত-ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে অর্জন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। কোন একটি অংশকে ছোট করে বা অস্বীকার করার অর্থ বাংলাদেশকে দুর্বল করা। আজ আমি মুক্তভাবে বলতে চাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা কারও বা কোন দলের রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি জনগণের ও ব্যক্তির দেশপ্রেমের অর্জিত সম্মান। তাদের রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় সম্মান দেবে কি দেবে না, এটা সরকারের নেতৃত্বের নীতিনির্ধারণী বিষয়। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা আর জন্মগ্রহণ করবে না, রাজনীতিক বা দলীয় কর্মী প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করবেন কিন্তু স্টেটসম্যান বা নেতা খুব কমই জাতির ভাগ্যে আসে। পঁচাত্তরে পরে নেতৃত্বহীন জাতি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। লেখক : সাবেক সরকারী কর্মকর্তা
×