ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. এ. এইচ.এম. জেহাদুল করিম

নিরাপদ অভিবাসন এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

নিরাপদ অভিবাসন এবং  বাংলাদেশ

১৮ ডিসেম্বর উদযাপিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস। এ দিনটিকে জাতিসংঘ কর্তৃক International Migrants and Refugees Day উধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অভিবাসিত জনশক্তির সম্মান ও সম-অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দও এ দিনকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০১৩ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন তাঁর প্রদত্ত এক বাণীতে বিশ্ব-দারিদ্র্য (global poverty) দূরীকরণে অভিবাসনের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রদত্ত বাণী থেকে জানা যায়, বিশ্ব-অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বর্তমানে ২৩২ বিলিয়ন অভিবাসী অভিবাসিত দেশগুলোতে তাঁদের শ্রম প্রদান করছেন। এতদসত্ত্বে এটি সর্বজনবিদিত যে, এই অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর অনেকে আজও তাদের ন্যূনতম মানবিক অধিকারটি অর্জন করতে সক্ষম হননি। এরই প্রাসঙ্গিকতায় বান কি মুন ২০১৩ সালে উল্লেখ করেন যে, Too many workers still now live in the worst conditions having least access to basic services and fundamental rights of themselves; thus making them disproportionately vulnerable to extortions, violence, discrimination and marginalization. এই প্রেক্ষাপটে, বান কি মুন তাঁর বাণীর মাধ্যমে পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের উদ্দেশে সনির্বন্ধ আবেদনে বলেন, ‘ÔOn this International Migrants Day, I urge the Governments to ratify and implement all core international human rights instrument… and reject xenophobia and embrace migration as a key enabler for the equitable, inclusive and sustainable social and economic development. তাঁর এই আহ্বানে এটি স্বীকৃত যে, জনশক্তি গ্রহণকারী দেশসমূহ যেমন একদিকে migrantsদের অধিকারকে নিশ্চিত করবে, তেমনি অপরদিকে জনশক্তি প্রেরণকারী দেশগুলোও তাদের অভিবাসনের প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ করবে। বান কি মুনের এই বাণী সর্বৈবভাবে দ্বৈত রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে। দিন বদলের লক্ষ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতি সম্প্রতি Switzerland I Bangladesh-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘Global Experts Meeting on Migration’’ শীর্ষক সেমিনারে এ বছরের ২৮ এপ্রিল, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বহির্গমনকারী শ্রমজীবী মানুষকে মানবিকভাবে গ্রহণ করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বপ্রতিনিধিবৃন্দকে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের কঠোর অঙ্গীকার এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার কথা মনে করিয়ে দেন। নির্দিষ্টভাবে অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর বিষয়টি সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, It is now also crucial that we all treat every migrant as a human being, not just as an element of economic activity of the production system. They must equally enjoy all rights, ...the rights as citizens, as the locals do. বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদন বাংলাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবীর অভিবাসীগোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য। প্রাচীনকাল থেকে অভিবাসন মানব জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জীবিকা নির্বাহের Open door policy) এক প্রধান কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নৃবিজ্ঞানীরা যেমন আদিম ক্ষুদ্র সমাজগুলোর মধ্যে অভিবাসনের একটি বিশেষ ধারা লক্ষ্য করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে অভিবাসনের দৃশ্যমান ইতিবাচক দিকটি বিবেচনায় নিয়েছেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে অভিবাসনের মাধ্যমেই ইউরোপ থেকে অগণিত মানুষ আমেরিকায় পাড়ি জমায়। আমেরিকার রাষ্ট্র গঠনের মূল শক্তিই ছিল অভিবাসন। ঙঢ়বহ ফড়ড়ৎ ঢ়ড়ষরপু-র মাধ্যমেই বিগত দশ বছর ধরে আমেরিকা, ইউরোপ ও পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষকে অভিবাসনে উৎসাহিত করা হয়। বলা বাহুল্য, এই অভিবাসনের মূল লক্ষ্যই ছিল একটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকে উৎসাহিত করা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জনশক্তি প্রেরণ ও গ্রহণ করার বৈচিত্র্যময় ধারায় সংযোজিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে ‘অভিবাসী শ্রমিকদের অস্থায়ী বসবাস এবং সেই সঙ্গে সেই দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা। চলমান বিশে^র ঐতিহাসিক অভিবাসনের ধারায় বাংলাদেশ কোন ক্রমেই পিছিয়ে নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়কাল ও তৎপরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অভিগমন করেছেন এবং এই অভিগমন সর্বদাই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে অধিকতর কম অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠী বহির্বিশ্বে তাদের কাজের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ঃবসঢ়ড়ৎধৎু ংবঃঃষবসবহঃ-এর মাধ্যমে ‘শ্রমজীবী গোষ্ঠী’ হিসেবে অভিগমন করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, আবুধাবী এবং সেই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের যথার্থ চাহিদা রয়েছে। কেননা আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিক-ভাইদের কর্মদক্ষতা, নৈপুণ্য এবং একাগ্রতা জনশক্তি আমদানিকারক দেশসমূহকে বেশ আকৃষ্ট করে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ঢ়ষধহঃধঃরড়হ ংবপঃড়ৎ-এ কাজ করার জন্যই সর্বপ্রথম ১৯৮৪ সালে ৫০০ শ্রমিকের একটি দল এ দেশে প্রবেশ করেছিল। পরে জি-টু-জি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই এদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত। অর্থনীতিবিদদের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জিডিপির ১২ শতাংশই আসে মূলত প্রবাসী রেমিটেন্সের উৎস থেকে। ২০০৯ সালে প্রবাসীদের পাঠান রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১০.৭২ বিলিয়ন ডলার যা ২০১৩ সালে ১৩.৭৮ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি অনেকেই এমনটি ধারণা করছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এমন ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। অতীতে, দেশের কিছু অবৈধ এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি প্রেরণের কারণে বিদেশে আমাদের শ্রমিক ভাইদের সামাজিক মর্যাদা অনেকাংশেই ক্ষুণœ হয়েছে। অসাধু এজেন্টগুলো শ্রমিক অভিগমনের জন্য উচ্চহারে ধার্যকৃত অর্থ গ্রহণের কারণে শ্রমিকেরা সেই অর্থ উসুল করার জন্য চুক্তির বাইরেও অতিরিক্ত সময়ের জন্য অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশী শ্রমিক ভাইয়েরা যাতে আর দেশী-বিদেশী এজেন্টদের দ্বারা প্রতারিত না হন তার জন্য সরকারী প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত স্বল্প খরচে, বৈধ কাগজপত্র সহকারে বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের পন্থা উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অনন্য সাফল্য। ‘জি-টু-জি’ এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে বৈধ শ্রমিক আমদানি করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, শ্রম ও জনশক্তিমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও মালয়েশিয়া সফর করেছেন। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালয়েশিয়া সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আরও ৬০ হাজার বৈধ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মালয়েশিয়ায়। গত এক বছরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার কারণে আমাদের পুঁজিবাজারে সম্প্রতি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রশংসনীয়ভাবে। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ আজ ২০১৪ সালে পৌঁছেছে। ঠরংরড়হ-২০২১ কে সামনে রেখে বর্তমান সরকার অত্যন্ত সুচিন্তিভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ২০১১ সালের ‘ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ওহফবী’-এর মানব-উন্নয়ন শ্রেণী বিভাজনে ‘নিম্ন-মানব উন্নয়ন’ বা ‘ষড়ি ফবাবষড়ঢ়সবহঃ রহফবী’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল; ক্রমানুবর্তিতায় তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম স্থানে কিন্তু ২০১৪ সালে মানব উন্নয়নের অবস্থানে বাংলাদেশ ১৪২তম স্থানে উঠে এসেছে এবং মানব উন্নয়নের শ্রেণী-বিভাজনে বাংলাদেশ একটি মধ্য-মানব উন্নয়ন শ্রেণীভুক্ত অর্থাৎ ‘গবফরঁস ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ওহফবী’-এর দেশে উন্নীত হয়েছে। আমাদের ধারণা ড. মাহাথীরের ২২ বছরের শাসন যেমনি মালয়েশিয়াকে একটি উন্নয়নশীল দেশের পর্যায় থেকে একটি সাফল্যক অগ্রসরমাণ দেশে পরিণত করতে পেরেছে তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল উন্নয়নের মডেল’ বাংলাদেশকে অচিরেই একটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করবে। আর এ জন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে এক সর্বৈব স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ। লেখক : মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ধযসুশধৎরস@ুধযড়ড়.পড়স
×