ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রোন তৈরি ও ব্যবহারে শীঘ্রই বিধিনিষেধ আসছে

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

ড্রোন তৈরি ও ব্যবহারে শীঘ্রই বিধিনিষেধ আসছে

আজাদ সুলায়মান ॥ কঠোর বিধিনিষেধ আনা হচ্ছে ড্রোন তৈরি ও ব্যবহারে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ, যখন তখন তার খেয়াল খুশিমতো দেশী প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরি ও উড়াতে পারবে না। এমনকি রাজধানীতে ড্রোন উড়ানো একেবারেই নিষিদ্ধ হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলকে ড্রোন জোন ঘোষণা করে অন্য এলাকায় ড্রোন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। বিধিনিষেধ অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। নতুন নীতিমালায় এ ধরনের শর্ত ও বিধিনিষেধ নিশ্চিত করা হচ্ছে। মূলত নাশকতায় ড্রোন ব্যবহার প্রতিরোধেই এ নীতিমালা প্রণয়ন করছে সিভিল এভিয়েশন। গত সপ্তাহে ধরা পড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই জঙ্গীর দেয়া স্বীকারোক্তিতে ড্রোন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তৎপর হয়েছে সিভিল এভিয়েশনও। সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অপারেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম জনকণ্ঠকে বলেন, এ নীতিমালার খসড়া তৈরি হচ্ছে। এতে ড্রোন তৈরি ও ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হবে। জননিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আপাতত জরুরীভিত্তিতে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড্রোন তৈরি ও যত্রতত্র উড্ডয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ মার্কিন ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ইকাও) এবং ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)। গত মাসে হংকংয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সিভিল এভিয়েশনের ডিজি পর্যায়ের এক সম্মেলনে এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব দেয়া হয়। এফএএ ইতোমধ্যে ড্রোন অপারেটে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ওই বৈঠকে অংশ নেয়া গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জঙ্গী তৎপরতাসহ নাশকতায় ড্রোন ব্যবহার করে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। তারপর ১৬ ডিসেম্বর ধরা পড়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্য তানভীর হোসেন বাবু ও গোলাম মওলা মোহন। তাদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় কাঠের তৈরি কোয়াড হেলিকপ্টার বা ড্রোনের রেপ্লিকা। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে ড্রোন ব্যবহার করে তাদের কী ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল- সে সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য ফাঁস করে। এমনকি শাহজালাল বিমানবন্দরে হামলারও পরিকল্পনার কথা জানায় তারা। সূত্র জানায়, এফএএর অভিমত জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় সিভিল এভিয়েশন বেশ গুরুত্বসহকারে ড্রোন তৈরি ও উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়। বর্তমানে এ জাতীয় ড্রোন নিয়ন্ত্রণে কোন নীতিমালা বা আইন নেই। এ সুযোগে ইচ্ছে করলে যে কেউ, যে কোন সময় যে কোন জায়গায় বসে, কিছু ইলেক্ট্রিক ডিভাইস ব্যবহার করে অনায়াসেই ড্রোন তৈরি করতে পারে, যা দিয়ে নাশকতার মতো কাজ অনায়াসে করা সম্ভব। সূত্র জানায়, হংকং বৈঠক থেকে ফিরেই সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম সানাউল হক ড্রোন ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। তাঁরই নির্দেশে এ নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেন তরুণ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম। ইতোমধ্যে এ টাস্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহেই এটা চূড়ান্ত করা সম্ভাবনা রয়েছে। কী থাকছে প্রস্তাবিত নীতিমালায় জানতে চাইলে বিস্তারিত কিছু বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনাম। তবে শুধু জননিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানান। বললেন, যে কেউ যখন তখন খেয়ালখুশি মতো একটা ড্রোন বানিয়ে, যেখানে সেখানে উড়িয়ে দেয়ার পরিণাম খুবই ভয়াবহ হতে পারে। এতে অনেক বিপজ্জনক পরিস্থিতি ঘটতে পারে। যেমন বারো বছরের একটা ছেলে নিষ্পাপ মনেই শুধু খেলাচ্ছলেও যদি দু’কেজি ওজনের একটা ড্রোন তৈরির পর হঠাৎ খোলা আকাশে উড়িয়ে দেয়, সেটা কখন কোথায় গিয়ে পড়ে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। যদি দুই কেজি ওজনের ওই ড্রোনটা রাস্তার কোন পথচারীর মাথায় পড়ে তাহলেও সে পঙ্গু হয়ে যাবে। যদি ড্রোনটা ৩-৪ কেজি ওজনের হয়, যেটা তৈরি খুবই সহজ, সেটা যদি কারও মাথায় পড়ে তাহলে কী হতে পারে পরিণাম, তা সহজেই অনুমেয়। অনিয়ন্ত্রিত ড্রোন তৈরি ও উড্ডয়নের ফলে জননিরাপত্তা বিঘিœত হবার অনেক আশঙ্কার কথা স্বীকার করে তিনি আরও যোগ করেন, এটা কাউকে আঘাত করার পাশাপাশি যে কোন ব্যক্তিজীবন ও প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা ফাঁস করা খুবই সহজ। যেমন ছোট্ট একটা ড্রোনে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে কোন ভবনের ওপর থেকে ভেতরের সমস্ত ছবি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে আনা সম্ভব। এমনকি কোন সেলিব্রিটি যদি তার ব্যক্তিগত সুইমিং পুলে প্রিয়জনের সঙ্গে গোপনে সুইম স্যুটপরা ছবিও ড্রোন ব্যবহার করে তার অজান্তেই নিয়ে আসা সম্ভব। পরে সেই ছবি দিয়ে তাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। ঘরে তৈরি ড্রোন দিয়ে মেধাবী তরুণদের এ ধরনের অপকর্ম করার আশঙ্কা রয়েছে। নাশকতার কাজেও কে কিভাবে করতে পারে সেটা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সাধারণ ড্রোন বা রিমোট কন্ট্রোল খেলনা হেলিকপ্টার দিয়েও নাশকতার মতো কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার আঙ্গিক থেকেও ড্রোন ব্যবহারে তাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। বড় কিছু না ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কী থাকছে নীতিমালায়? এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালায় বেশকিছু প্রস্তাব থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে গোটা দেশকে একাধিক জোনে বিভক্ত করে ড্রোন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা ও সীমিত আকারে কিছু এলাকায় ড্রোন উড্ডয়নের অনুমতি দেয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সূত্র মতে, তারপরই রয়েছে ড্রোন তৈরি ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারকদের বয়সসংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা। কিশোর বয়সের কা-জ্ঞানহীন ছেলেমেয়ে বিশেষ করে আঠারো বছরের নিচের কাউকে ড্রোন তৈরি ও উড্ডয়নের অনুমতি না দেয়া। গোপনে কেউ করলেও তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। ড্রোন তৈরি ও উড্ডয়নের আগে সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রাখার প্রস্তাব থাকছে। রাজধানীতে অপ্রয়োজনে ড্রোন বা কোয়াড হেলিকপ্টার তৈরি ও উড্ডয়নের ওপর খুব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ রয়েছে। কারণ পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় অনিয়ন্ত্রিত ড্রোনের ব্যবহারের ফলে ব্যাপকহারে নাগরিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ড্রোন উড্ডয়নের ফলে যদি সেটা রিমোটের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয় কিংবা ফিরিয়ে আনার সময় সেটা যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে কোন জনবসতির মাঝে পড়ে, তাহলে হতাহত অনিবার্য। এ কারণেই চর ও পাহাড়ী অঞ্চলের কিছু খোলা জায়গায় এ জাতীয় ড্রোন উড্ডয়নের অনুমতি প্রদান। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ড্রোন তৈরি ও উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু সিভিল এভিয়েশনের একার নয়। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এখানে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ আকাশে বেসামরিক উড়োজাহাজের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীরও বিভিন্ন ক্যাটাগরির উড়োজাহাজ উড়ে। মোট কথা এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞের মতে, ড্রোন যে শুধু খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, হতে পারে সেটাও ঢালাওভাবে বলা সমীচীন হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনে বসে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে ড্রোন ব্যবহার করে হরহামেশাই ইরান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বোমা হামলা করা হচ্ছে। তরুণ বিজ্ঞানীরা গবেষণামূলক কাজেও ড্রোন তৈরি ও ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ আছে। বুয়েটসহ দেশের অন্যান্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট আকারের ড্রোন তৈরির মতো যথেষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। জঙ্গী নাশকতার অজুহাতে তাদের এর বাইরে রাখা যাবে না। তাদের একটা গাইডলাইনের আওতায় ড্রোনসংক্রান্ত গবেষণার কাজ করতে দিতে হবে। ড্রোন কী? ড্রোন মনুষ্যবিহীন এক ধরনের উড়োজাহাজ। পাইলট ছাড়াই দূরনিয়ন্ত্রিত রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা চালানো হয় এটি। সুদূর মার্কিন পেন্টাগনে বসে রিমোটের সাহায্যে আফগানিস্তানের গহীন অরণ্যের কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এ ড্রোন। এতে বহন করা যায় শক্তিশালী বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য। এ সময়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান নিধনের কাজে ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখন আতঙ্ক। ড্রোন দিয়ে কখন কার ওপর হামলা চালানো হয়, এমন আতঙ্কেই দিন কাটছে আফগানীদের। ড্রোন সাধারণ দুই ধরনের হয়। একটি রিমোট পাইলটিং ভেহিক্যাল, অপরটি আনমেন এরিয়াল সিস্টেম (ইউএএস)। বর্তমানে যুদ্ধবিগ্রহে শত্রুর ঘাঁটিতে আঘাত হানার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে রিমোট পাইলটিং ভেহিক্যাল। এ ছাড়া কোনকিছু নজরদারি করা, আবহাওয়ার গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া, প্রতিপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে গোপন তথ্যাদি সংগ্রহের কাজে সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে জন্যই এ জাতীয় ড্রোন খুবই শক্তিশালী। ড্রোনকে বলা হয় ফ্লাইং রোবট। ড্রোন অস্ত্রবহনকারী এবং নিরস্ত্র দুই ধরনেরই হতে পারে। শুধু শত্রুকে আঘাত করা ছাড়াও প্রতিপক্ষের গোপনীয় তথ্য ও চিত্র সংগ্রহের কাজেও মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় এটি। সে তুলনায় আনম্যান এরিয়াল সিস্টেম এত শক্তিশালী নয়। মেলায় বিক্রি হওয়া রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। ছোট্ট চারটা পেন্সিল ব্যাটারির শক্তিতে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে এটি ৭০ ফুট পর্যন্ত উড়ানো সম্ভব। আবার সেটা নিচে আনাও সম্ভব। যদি এতে উচ্চশক্তি ব্যবহার করা হয়, তাহলে পঁচিশ কেজি পর্যন্ত ভার বহন যোগ্য হতে পারে এটি। আর ভয়টা সেখানেই। যে কোন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ও বোমা বহন করে সেটা দিয়ে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানা সম্ভব। এমন বাস্তবতার আলোকেই ড্রোন নিয়ে এখন ভাবতে হচ্ছে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রেও জানা যায়, ড্রোন ব্যবহারে কোন অশুভ শক্তি যাতে কোন ধরনের নাশকতা করতে না পারে, সে জন্য তৎপর থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থাকে। এতে ঢাকা মহানগর পুলিশসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও তৎপর হয়েছে বলে জানা যায়।
×