ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক এখ্লাসউদ্দিন

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

চলে গেলেন বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক এখ্লাসউদ্দিন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছন্দ নিয়ে খেলা। ছন্দের সঙ্গে খেলা। স্বাচ্ছন্দ্য বসবাস। অর্ধ শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের শিশু সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা। সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। আর তার পর জীবনের ইতি। অনিবার্য ছন্দপতন। সাহিত্যের পথে দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে বিদায় নিয়েছেন এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ। ষাটের দশকে বাংলার সাহিত্য আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা পথিকৃৎ শিশুসাহিত্যিক বুধবার ভোর ৪টায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। চিরকুমার এখ্লাসউদ্দিনের বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বিশিষ্ট এই শিশু সাহিত্যিক দীর্ঘদিন দৈনিক জনকণ্ঠে কর্মরত ছিলেন। জানা যায়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে এক মাসের মতো সময় হাসপাতালে ছিলেন এখ্লাসউদ্দিন। কয়েকদিন আগে অবস্থার আরও অবনতি হলে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। সকালে মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে লেখকের গুণগ্রাহী বন্ধু সহকর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যান। শেষবারের মতো তাঁকে দেখেন। শিশু সাহিত্যিকের মরদেহ বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলা একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, শিল্পী হাশেম খান, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুর, শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম, আসলাম সানী, সুজন বড়ুয়া, রহীম শাহ, সিরাজুল করিম, ফরিদা আখতার, দিলারা মেসবাহ, কবি লিলি হক, লেখক নিলুফার বেগম, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভানেত্রী রওশন আরা বেগম, সাধারণ সম্পাদক লিপি মনোয়ার, তাহমিনা কোরাইশী প্রমুখ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন করে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চয়ন সাহিত্য ক্লাব, পদ্মরাগ, ইনার হুইল ক্লাব, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বনলতা সাহিত্য পরিষদ, নন্দিনী সাহিত্য সংসদ, দুর্জয় বাংলাসহ কিছু সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, শিশুসাহিত্যিক হিসেবে এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ ছিলেন অনন্যসাধারণ। তাঁর ‘এক যে ছিল নেংটি’, ‘তুনুর দুপুর’, ‘তুনুর হারানো পুতুলগুলো’, ‘বৈঠকি ছড়া’, ‘প্রতিরোধের ছড়া’ বাংলা শিশুসাহিত্যের স্বর্ণসম্পদ। তাঁর সৃষ্ট শিশু চরিত্র ‘তুনু’ কয়েক প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের প্রিয় চরিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাহিত্য-সংগঠক হিসেবেও এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ ছিলেন অসাধারণ। শিশুসাহিত্যের পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ সম্পাদনা এবং চট্টগ্রামের বইঘর প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে আধুনিকতা ও রুচিস্নিগ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ছিল সাহসী ভূমিকা। এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদের মৃত্যুতে আমরা একজন গুণী সাহিত্যসেবীকে হারালাম। পরে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জানাজা। একাডেমি থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লেখকের মোহাম্মদপুরের বাসায়। বাদ জোহর জাকির হোসেন রোডের খেলার মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদকে। এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ ১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। গোড়া থেকেই ছন্দের প্রতি প্রেম। সেই ছন্দ নিয়ে খেলেছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন। শিশু কিশোরদের উপযোগী করে লিখেছেন। ছড়ায় ছড়ায় কী যে সুন্দর বলা তাঁর! গল্পে উপন্যাসও অনন্যসাধারণ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ‘তুনু’, ‘তপু’ ও ‘কেঁদো’ সে সময় শিশুদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ষাটের দশকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে অত্যন্ত জনপ্রিয় শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’। মাসিক এই প্রকাশনা তখন বাংলাদেশের শিশু সাহিত্যের যাত্রাকে নতুন গতি দেয়। এতে দেশের বিখ্যাত প্রায় সব লেখক কবি লিখেছেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘সীমান্তের সিংহাসন’ প্রকাশিত হয় পত্রিকাটিতে। স্বাধীনতার পর প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অঙ্গসজ্জায় ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী ও আবুল র্আক আলভী। সমৃদ্ধ লেখক তালিকায় ছিলেনÑ শামসুর রাহমান, সরদার জয়েন উদদীন, হাবীবুর রহমান, সুকুমার বড়ুয়া, আহমেদ হুমায়ুন, আবুল হাসনাত, বুলবন ওসমান, আলী ইমাম, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ভূঁইয়া ইকবাল, সরদার ফজলুল করিম, করুণাময় গোস্বামী, জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, মাহমুদুল হক, সুচরিত চৌধুরী, আহসান হাবীব, শওকত আলী প্রমুখ। সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় লেখেন শামসুর রাহমান, আবুল মনসুর, রণেশ দাশগুপ্ত, শওকত আলী, আসাদ চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন শর্মার মতো খ্যাতিমানরা। এভাবে প্রায় প্রতিটি সংখ্যাই হয়ে উঠত অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ‘টাপুর টুপুর’ সম্পর্কে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী রিয়াজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেনÑ রুচিশীল প্রকাশনা বলতে যা বোঝায়, তার একটা অনন্য উদাহরণ বলে বিবেচিত হতে পারে ‘টাপুর টুপুর’। কিশোর সময়ে এই পত্রিকাটি হাতে পাওয়া আমাদের জন্যে ছিল বড় ধরনের প্রাপ্তি। এখ্লাসউদ্দিন নানা দেশের গল্প, ছড়া ও কবিতার সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘এক যে ছিল নেংটি’; ‘হঠাৎ রাজার খামখেয়ালী’; ‘কাটুম কুটুম’; ‘ছোট্ট রঙিন পাখি’ এবং তনু ও তপু সিরিজের কয়েক ডজন বই বিশেষ প্রশংসিত হয়। সঙ্কলন গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বাছাই করা গল্প উপন্যাস’, ‘দুই বাংলার ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’, অশোক কুমার মিত্রের সঙ্গে সম্পাদিত ‘দুই বাংলার নির্বাচিত কিশোর গল্প’, ‘সমগ্র ও সঙ্কলন-১’ ইত্যাদি। বিভিন্ন রচনায় শিশুদের নির্মল বিনোদনদানের পাশাপাশি সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন তিনি। প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁর গদ্য পদ্য ধারণ করেছে রাজনৈতিক প্রতিবাদও। পাকিস্তানীদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছড়ায় প্রতিবাদ করেছেন। হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতিবাদ করে এখ্লাসউদ্দিন লিখেছেন, ‘হরতাল -/ আজ হরতাল/ পেটা ঢাক ঢোল/ ছোঁড় সড়কি/ আন বল্লম/ ধর গাঁইতি/ ধর বর্শা/ দাও হাতে হাত/ এই কাঁধে কাঁধ/ তোল ব্যারিকেড/ গড়ো প্রতিরোধ/ কালো দস্যির/ ভাঙো বিষ দাঁত/ ধরো হাতিয়ার/ করো গতিরোধ/... খোল করতাল/ আজ হরতাল। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয় পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠে। তবে ছড়াকার ও সংগঠক হিসেবে ছিল তাঁর বিপুল খ্যাতি। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ যুব উৎসব পুরস্কার, ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪ সালে কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং ২০০৭ সালে ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
×