ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আদালত বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছেন ॥ রায়টি উৎসর্গ করা হলো বীরাঙ্গনা আর যুদ্ধশিশুদের প্রতি

বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা যেন ভুলে না যাই

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা যেন ভুলে না যাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের এই প্রথম বারের মতো অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, যে যুদ্ধশিশু জন্ম থেকে সামাজিক নিগ্রহ, ধিক্কার, গঞ্জনা বা বঞ্চনা নিয়ে বড় হচ্ছে তারা সাহসী নারী। তাদের আমরা স্যালুট জানাই । বুলেটের আঘাতের চেয়েও ধর্ষণের আঘাত অনেক যন্ত্রণাদায়ক, ভয়ঙ্কর। একাত্তর সালে শত্রুর গুলিতে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাঁদের থেকেও যন্ত্রণাদায়ক হলো যাঁরা একাত্তর সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সামাজিকভাবেও এ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এ জন্য আদালত বলেছে, একাত্তরে যুদ্ধশিশু, ধর্ষিত নারী ও যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁদের তালিকা করে পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেছে ট্রাইব্যুনাল । মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আসামি সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৪টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগে ফাঁসি, ৪টিতে আমৃত্যু কারাদ-, ৩টিতে ২২ বছরের কারাদণ্ড ও দুটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। আসামি কায়সারের বিরুদ্ধে মোট ৩২ জন সাক্ষী তাঁদের জবানবন্দী প্রদান করেছেন। এর মধ্যে কায়সারের বিরুদ্ধে দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। রায়ে সাঁওতাল নারী হীরামনি ও মাজেদা নামের অপর নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ দু’টি প্রমাণিত হয়েছে । ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী ও ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন দিয়েছেন কায়সারের বিরুদ্ধে। শামসুন্নাহার নামের ওই যুদ্ধশিশু দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কায়সারের যুদ্ধাপরাধ মামলায়। ৪২ বছর বয়সী নারী সাক্ষী শামসুন্নাহার কায়সারের ধর্ষণের শিকার হওয়া একজন বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যুদ্ধকালীন ধর্ষণ সাধারণ ধর্ষণের মতো নয়। যে সাহসী নারীরা একাত্তরের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাঁরা সারা জীবন লড়াই করে যাচ্ছেন। তাঁরা সন্তান ধারণে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের ক্ষতি অপূরণীয়। এই ক্ষতিটা কেউ পূরণ করতে পারবে না। ৭৩ সালের আইনে সরাসরি ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা নেই। তবে রুলসে আছে। যেহেতু রুল আর মেইন আইন সাংঘর্ষিক। এক্ষেত্রে ৭৩ সালের আইনটি প্রাধান্য পাবে। সে জন্য আমরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারছি না। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনা সদস্য ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে দুই লাখেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে সৈয়দ কায়সারের মামলায় ধর্ষিত দুই নারী ও এক যুদ্ধশিশু সাক্ষ্য দিয়েছেন। এটা বিরল ঘটনা। ট্রাইব্যুনাল রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁরা আমাদের দেশের জাতীয় বীর। আজ আমাদের সময় এসেছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযদ্ধের পরপরই মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার। নিঃসন্দেহে এ উদ্যোগ ইতিবাচক। এ জাতীয় বীরদের ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত ছিল। যদিও তাদের ত্যাগ এবং অসীম ক্ষতি পূরণযোগ্য নয়, তবু ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিদ্যমান আইনে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এতদিন রাষ্ট্র সমাজ এসব জাতীয় বীরদের বিষয়ে যে নীরবতা এবং অমনোযোগিতা প্রকাশ করেছে এখন সেটা করার আর কোনো সুযোগ নেই। তিনি পাকিস্তানী সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান। রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিকটিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবে। আসামি কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ যখন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে সে সময় বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত যুক্তিতর্কে বলেন, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি একাত্তরে সৈয়দ কায়সারের অপরাধের শিকার বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, কায়সারের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ আমরা সাক্ষী ও দলিল দস্তাবেজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তাই আদালতের কাছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- কামনা করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী বিচারের মধ্যে একমাত্র এই মামলায় আসামির শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি তার সম্পত্তি থেকে (ভিকটিম) ধর্ষিতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আবেদন জানিয়েছি। কায়সারের বিরুদ্ধেই একমাত্র যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার জবানবন্দী পেশ করেছেন। শামসুন্নাহারের জন্ম তার মায়ের ঔরসে হলেও তিনি পাকিস্তানী সেনাদের ধর্ষণের ফসল। জন্মই যার আজন্ম পাপ। জন্মের পর থেকে তাঁকে সামাজিকভাবে অবহেলা নিগ্রহ অপমানের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। তাদের জীবনের যুদ্ধ আসলে কখনোই শেষ হয় না। রায়ের পর প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘এ রায়ে আমরা আনন্দিত।’ তিনি জানান, যুদ্ধশিশুদের জন্য ‘কমপেনসেশন স্কিম’ চালু ও তাদের পুনর্বাসনে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেয়া উচিত বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের ‘ওয়ার হিরো’ উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেখা উচিত। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, ‘এ রায় একটি বিরাট অর্জন।এ রায় আমরা একাত্তরের বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রতি উৎসর্গ করছি।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনা সদস্য ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে দুই লাখেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন বলে ধারণা করা হয়। নির্যাতিত এই নারীদের অনেকেই সে সময় গর্ভবতী হয়ে পড়েন, জন্ম নেয় অনেক যুদ্ধশিশু। অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নারীদের সম্মান জানান তাদের বীরাঙ্গনা বলে। চলতি বছর নির্যাতিত এই নারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। ১৯৭২ সালে অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস এই ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন। তাঁর ভাষায়, পাকিস্তানী বাহিনী একাত্তরে ধর্ষণকে বাঙালীর বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্ষণের যে দুটি অভিযোগে কায়সারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। যে দুটি অভিযোগ রয়েছে : ১৯৭১ সালের ১১ মে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা করেছিল। ১২নং অভিযোগে বলা হয়েছে, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট দুপুর বেলা হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার বেলাঘর, জগদীশপুর হাইস্কুলে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া ও মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে আটক করে এবং তাদের বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য করানো হয়। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
×