ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

আওয়ামী লীগের ৬৫ বছর

প্রকাশিত: ০৩:০৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

আওয়ামী লীগের ৬৫ বছর

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ৬৫ বছর কেটেছে মিলিটারি অকুপেশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই মিলিটারি অকুপেশনের সূত্রপাত ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে। সূচনাতেই সিভিল কর্তৃত্ব হটিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান এবং মিলিটারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে পাকিস্তান। এই কর্তৃত্ব অব্যাহতভাবে চলেছে ৩০ বছর। আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষকে একত্র করেছে অকুপেশনের বিভিন্ন দিকের বিরুদ্ধে এবং সমমনা রাজনৈতিক দল : কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মুজাফফরকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছে। এই লড়াই সাধারণ মানুষদের, সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের এবং গেরিলাদের, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৭১-এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই রাজনৈতিক সময় ও ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর করেছে। স্বাধীনতার অর্থ সিভিল কর্তৃত্ব : এই অর্থ প্রতিষ্ঠার লড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখনও অব্যাহত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিভিল কর্তৃত্ববিরোধী রাজনীতি উন্মোচিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ এই রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সামরিক কর্তৃত্ব মিলিটারি অকুপেশনের যে ছদ্মনাম, সেই অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ সরে আসেনি। স্বাধীনতা অব্যাহত রাখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন সিভিল কর্তৃত্ব এবং সিভিল কর্তৃত্ব বাদে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হয় না। বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ইতিহাসের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ হস্তক্ষেপ করেছে সিভিল কর্তৃত্ব নিয়ে আর বিএনপি করেছে সামরিক কর্তৃত্বের রাজনীতি নিয়ে। প্রথমটা থেকে উত্থিত হয়েছে গণতন্ত্র এবং দ্বিতীয়টা থেকে উত্থিত হয়েছে স্বৈরতন্ত্র। মিলিটারি অকুপেশনের রাজনীতির অন্য অর্থ সাধারণ মানুষের কর্তৃত্ব হটিয়ে দেয়া এবং সাধারণ মানুষের কর্তৃত্বহীন রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও শ্রেণীর মধ্যে একটি টেনশন থাকে। এই টেনশন থেকে আওয়ামী লীগ মুক্ত নয়। এই দ্বন্দ্ব এই টেনশন তৈরি করেছে আওয়ামী লীগের মতাদর্শ। বিএনপি এই ক্ষেত্রে ক্ষমতার মতাদর্শ তৈরি করেছে এবং সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রিপ্রেসিভ পলিসি তৈরি করেছে এবং বিএনপি ছদ্মনামে জামায়াতের রাজনৈতিক সশস্ত্রতার অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদী মতাদর্শিক পারস্পেক্টিভের দিকে অগ্রসর হয়েছে। অন্য পক্ষে আওয়ামী লীগ বেঁচে থাকার সংগ্রামকে রাজনৈতিক লড়াই হিসেবে গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় পপুলার ডেমোক্রেটিক মতাদর্শ র‌্যাডিক্যাল হয়েছে। মিলিটারি অকুপেশন ও কলোনিয়ালিজম পরস্পর প্রবিষ্ট। এই প্রবিষ্টতার দরুন কলোনিয়াল সময়ে ধানের অধিকার কেড়ে নিয়েছে মিলিটারি অকুপেশন, জ্ঞানের অধিকার কেড়ে নিয়েছে মিলিটারি অকুপেশন এবং মুক্তির অধিকার কেড়ে নিয়েছে মিলিটারি অকুপেশন। মিলিটারি অকুপেশন সৃষ্ট কলোনিয়ালিজম ভেঙ্গে চুরমার করেছে সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের সন্তানসন্ততি মুক্তিযুদ্ধের ফৌজ হয়ে উঠেছে এভাবে। আর যুদ্ধের পর যারা ক্ষেতখামারে এবং পাড়ামহল্লায় ফিরে যায়নি তারাই ভিড় করেছে জিয়াউর রহমান নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে, ভিড় করেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির আখড়া বিভিন্ন মাদ্রাসায় এবং ভিড় করেছে জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডার বাহিনীতে। আওয়ামী লীগ প্রথম থেকে এসব শক্তির বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ কখনও জিতেছে, কখনও হেরেছে; এই লড়াই এখনও অব্যাহত। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব সেক্যুলার, রাজনীতির বোধ তৈরি করা। এই বোধ তৈরি করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল। কলোনিকালে, পাকিস্তান আমলে, পাকিস্তান রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিচালক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামী সেক্যুলার রাজনীতির বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য : যারা সেক্যুলার রাজনীতি করে, তারা হিন্দু, তারা ভারতপন্থী, আর যারা নন-সেক্যুলার রাজনীতি করে তারা মুসলমান। জিয়াউর রহমান এই অবস্থানের মধ্যে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপির মতাদর্শ হিসেবে এই রাজনীতিকে শক্তিশালী করেছেন। যে ক্ষেত্রে বিএনপি রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কর্তৃত্ববিরোধী ফর্ম তৈরি করেছে, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের কর্তৃত্বভিত্তিক ফর্মের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থানের মধ্যে একত্র হয়েছে পপুলিজমের বিভিন্ন ধারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক পজিশিন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যেন একটা মহানদী বিভিন্ন নদীকে নিয়ে সমুদ্রের দিকে যাত্রা করেছে। বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ইতিহাস এক হিসেবে এই মহানদীর সঙ্গে বিভিন্ন নদীর সমুদ্রের দিকে যাত্রা করার স্রোত। এখান থেকে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্রিটিক, জাতীয়তাবাদের ক্রিটিক এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান সম্বন্ধে ইউটোপিয়ার ইতিহাস। সেজন্য মতাদর্শ ও ইউটোপিয়ার যুক্ত ট্রিটমেন্ট জরুরী হয়ে পড়েছে, তাহলেই সমাজ বাস্তবতার দিকে স্বচ্ছভাবে তাকানো সম্ভব হবে।
×