ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ বাঘ শুধু মামা নয়, গানও গায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

এ বাঘ শুধু মামা নয়, গানও গায়

মোরসালিন মিজান ॥ পটচিত্রের এমনিতেই স্বতন্ত্র আবেদন। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই ধারায় দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন শিল্পীরা। অনেকেরই জানা, পট শব্দের অর্থ কাপড়। আর এই কাপড়ের ওপর রং তুলিতে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। তখন একে বলা হয় পটচিত্র। বহুকাল আগে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল। এখনও আছে পট। ভীষণ ভালবেসে ছবি আঁকেন পটুয়ারা। তবে একেবারেই ব্যতিক্রম বলতে হবে নাজির হোসেনকে। পট আঁকেন তিনি। লোক চিত্রকলার বিশেষ এই ধারায় বাংলাকে তুলে ধরেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে প্রধান অনুষঙ্গ করেন বাঘকে। ডোরাকাটা প্রাণীটি পটের মূল চরিত্র বা নায়ক হয়ে ওঠে। দুই দশটিতে নয়, সব পটচিত্রে ঘুরে ফিরে বাঘ আসে। দেশজ রং দিয়ে নিজের কল্পনাকে আঁকেন পটুয়া। টুকরো কাপড় বা কাগজে ভাবনার জগত মেলে ধরেন। এভাবে বিচিত্র অবয়ব আর রং ঢংয়ে প্রকাশিত হয় এক একটি বাঘ। নাজিরের আঁকা বাঘ সত্যি বাঘের মতো দিব্যি গাছে চড়ে, নদীর জলে নামে। তবে এখানেই শেষ নয়। বৈঠা হাতে নৌকো বাইচে অংশ নেয়। শুধু গর্জন নয়, গানও গায়। রাখালের বাঁশিটি কায়দা করে ঠোঁটে ধরে। বাজায়। একইভাবে উৎসবে মাতে বাঘ। তাকদুম তাকদুম ঢোল বাজায়। একতারায় সুর তুলে। বিদ্যে বুদ্ধিও কম নয়। মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করে। একই বাঘ ক্ষেত খামার করে। জমিতে যায়। পট আঁকার পাশাপাশি রীতি অনুযায়ী তিনি গানও জুড়ে দেন ছবির সঙ্গে। উদাহরণ হতে পারে সুন্দরবন নিয়ে লেখা তাঁর পটের গান। পটুয়া লিখেছেনÑ সুন্দরবনে থাকি/সব পশুদের রাজা/আমার রাজ্যে দস্যু এলে দেব তারে সাজা। এভাবে ছবি ও গানে সৃষ্টি করেন শিল্পভাষা। কল্পনাপ্রিয় শিল্পীমন শাপ, পাখি, প্যাঁচা ইত্যাদির মুখেও বাঘের প্রতিকৃতি জুড়ে দেন। শিল্পীর মনোজগতের এই খেলা বুঝতে হলে একটু শৈশবে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে। তখন তাঁর কাছে বাঘ মানে, বাঘ মামা। মনে পড়ে? সেই বাঘ মামার শক্তি সাহসের কত কত গল্প! না, বড় হওয়ার পর সব গল্প মিথ্যে হয়ে যায়নি। বাঘ প্রকৃতই বাহাদুর। এর উপস্থিতি আরও অনেক উপস্থিতিকে ম্লান করে দেয়। বনকে বিশেষ গরিমা দেয় বাঘ। আভিজাত্য যোগ করে। শৈশব থেকেই নাজির ব্যাপারগুলো খেয়াল করেছেন। পরিণত বয়সে দিয়েছেন শিল্পভাষা। ঠিক কবে থেকে এমন আঁকা? কী করে এত আপন হলো বাঘ? জানতে চাইলে পটুয়া বলেন, শুরুটা অন্য সবার মতোই। গ্রামের ছেলে। শৈশবে ফুল পাখি নদী নৌকো এঁকেছি। এরই অংশ হয়ে এসেছে পশু পাখি। বাঘও আঁকা হতো। আঁকতে আঁকতেই কেমন যেন প্রেমে পড়ে যাই। বন্ধু হয়ে ওঠে বনের বাঘ। বয়স বাড়লে বুঝি, বাঘের শৌর্য বীর্য আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। মানুষ বড় কোন সাফল্য পেলে তাঁকে ‘বাঘের বাচ্চা’ বিশেষণে ডাকা হয়। বাঘ আদরেরও খুব। তাই বাঘ মামা। সব মিলিয়ে বাঘ আমাকে যারপরনাই আকৃষ্ট করে। এভাবে এটি আমার সিগনেচার টিউন হয়ে যায়। এখন আমাকেই বাঘমামা বলে ডাকা হয়। পটুয়া জানান, এখন বাঘ তাঁর কাছে বাংলাদেশের প্রতীক। নিজস্ব এই ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। নাজির নিজের বাসায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে বসে বাঘ আঁকেন তিনি। এসব এলাকার তিনি পরিচিত মুখ। বিদেশেও গিয়েছেন। জাপানে নিয়ে গেছেন তাঁর বিচিত্র বাঘের সংগ্রহ। দেশেও একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। সব প্রদর্শনী থেকেই শিল্পী বাঘ রক্ষার আহ্বান জানান। প্রসঙ্গটি ওঠতেই একটু মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। বলেন, সুন্দর বনের বাঘগুলোর জীবন শঙ্কায় পড়ে গেছে। এদের রক্ষার জন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শিল্পী।
×