ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরদার সিরাজুল ইসলাম

বাঙালী বিজয়ী জাতি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪

বাঙালী বিজয়ী জাতি

(১৯ ডিসেম্বরের পর) মেজর জিয়া ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলায় স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা (বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৯ম খণ্ড পৃ. ৪৪-এ সংযোজিত দলিল) এবং ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। এই রচনায় মেজর জিয়া উল্লেখ করেছেন যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাঁর কাছে গ্রীন সিগন্যাল মনে হয়েছিল। তিনি যে ২৫ মার্চ রাত ১১টায় ‘সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন, তাও উল্লেখ রয়েছে। উক্ত নিবন্ধে ২৭ মার্চ/ ৭১ তারিখ সন্ধ্যায় পরে জিয়াউর রহমান যে ভাষণ দেন তাঁর স্বকণ্ঠে বাণীবন্ধ টেপ থেকে নিম্নে তুলে দেয়া হলো :- The Government of the Sovereign State of Bangladesh on behalf of our Great Leader, The supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, we hereby proclaim the independence of Bangladesh and the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of seventy Five Million People of Bangladesh, and the Government headed by him is the only legitimate government of the Independent Sovereign government of the people of the Independent Sovereign State of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed, and is worthy of being recognized by all the governments of the World. I therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the government of all the democratic countries of the world, specially the Big Power and the neighboring countries to recognize the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The guiding principle of a new state will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. JOY BANGLA”. বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ/ ৭১ যে স্বাধীনতার ঘোষণার দেন তারই সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধ এগুতে থাকে এবং ১০ই এপ্রিল/ ৭১ মুজিব নগরে সরকার গঠন ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে। উক্ত দলিলটি সংবিধানের উৎস এবং অংশ হিসেবে মুদ্রিত। মুজিব নগর সরকারের কর্মকর্তারা হলেন : (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি, (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, (৩) তাজউদ্দীন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যগণ : (১) ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, (২) কামারুজ্জামান এবং (৩) খন্দকার মোশতাক আহমদ মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য (আওয়ামী লীগ) কর্নেল এম, এ, জি ওসমানীকে জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। বস্তুত: বঙ্গবন্ধুর নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মুজিব নগর সরকারে নিযুক্ত বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার, গণবাহিনী, মুজিববাহিনীসহ অসংখ্য বাহিনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া মুজিব নগর সরকারের একটি উপদেষ্টা কমিটি ছিল যার প্রধান ছিলেন মওলানা ভাসানী। নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১১টি আঞ্চলিক বেসামরিক প্রশাসন। ॥ দুই ॥ মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল। জনযুদ্ধ, সামরিক বিদ্রোহ নয়। অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পাক-হানাদার বাহিনীকে বিতারণ। তৎকালীন জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ছিল কোন রাষ্ট্রের অংশ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে কোন জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র স্বীকৃতি বা সহযোগিতা দেবে না। অথচ বিশ্বের জনমত ও প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া কোন রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে এমন কোন নজির নেই। বঙ্গবন্ধু এই বাস্তবতার আলোকে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পরেই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। যার ফলে বিশ্ববাসীর সমর্থন পাওয়া যায় এজন্য যে এটি মামুলি কোন বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন বা হঠকারিতা নয়। একটি নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং পাক জান্তা সেই দলের নেতাকর্মী এবং সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ বাঙালীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প ছিল না এটা বিশ্ববাসীর কাছে নিশ্চিত করতে পারলেই সমর্থন পাওয়া যায়। আর বঙ্গবন্ধু যদি ভারতে যেতেন তাহলেও এতটা ক্রিয়াশীল হতো না। বন্ধী হওয়ার ফলে তার মুক্তি ও স্বাধীনতা সমার্থক হলে বেগবান হয়েছিল (বঙ্গবন্ধুর জন্য রোজা রেখেছেন হাজারো বাঙালী)। বঙ্গবন্ধুর এই কৌশলটি যথাসময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গমতার একটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে বিশ্বে প্রশংসিত। বস্তুত: পাকবাহিনী আক্রমণ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। ভেবেছিল তাদের নেতা মুজিবকে বন্দী করলেই বাঙালীরা ঠাণ্ডা হবে। কিন্তু এটা যে জনযুদ্ধে পরিণত হবে তা কল্পনা করতে পারেনি। তাই পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রথম প্রহরে প্রতিরোধ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এটা তাদের জন্য ফরজ ছিল। মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল গৌরবময়। মওলানা ভাসাণী মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা তথা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করলেও তাঁর অনুসারীরা চীনপন্থী হওয়ায় এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় ওরা কার্যত পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন। উল্লেখ্য যে, চীনপন্থী সর্বহারা পার্টির নেতা কমরেড আবদুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। একই অভিযোগ কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার বিরুদ্ধে। আনোয়ার জাহিদ পাকবাহিনীকে রসদ সরবরাহ করে মুরগি সাপ্লাইয়ার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ভাসানী ন্যাপ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিঞা শেষ পর্যন্ত কলাবরেটর আইনে আটক হয়েছিলেন। যাদু মিঞা, কাজী জাফরÑ এরা ভারতে গিয়ে মওলানা ভাসানীকে দেশে আনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী তাঁদের ফাঁদে পা দেননি। অন্যান্য ডাকসাইটে চৈনিক নেতা যেমন মান্নান ভূইয়া, খোকা এরা কোথায়, কার পক্ষে ছিলেন তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এটি নিশ্চিত হয়েই পাকবাহিনীতে কর্মরত বাংলাভাষী সেনার একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। অবশ্য ২৫ মার্চ (৭১) পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাংলাভাষী সেনা কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৭৬ জন কিন্তু এর মধ্যে ৯৪ জন পাকবাহিনীর পক্ষেই ছিলেন আর মাত্র ৮২ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এছাড়া ছুটিতে অবস্থানরতদের মধ্যে ২২জন (তবে এরশাদ ছুটিতে এসেও পাকিস্তানেই ফিরে যান) এবং খুনী রশিদ, ফারুক, ডালিমসহ ৩১জন মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান থেকে ছুটিতে এসে যোগ দেন। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান মেজর (অব) সামসুল আবেদীন-ইউ.পি.এল ১৯৯৫)। এই প্রেক্ষিতে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তর বলেছেন, “কোন সৈনিকের পক্ষেই স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা নেই। এ দায়িত্ব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অর্থাৎ জনগণের নির্ধারিত আস্থাভাজন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত না হয়ে কোন সৈনিকের পক্ষে পাকবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা বা বিদ্রোহ করা সম্ভব ছিল না। কেননা সে সময়ে যদি রাজনৈতিকভাবে ঘটনার মীমাংসা হয়ে যেত সে ক্ষেত্রে যদি কোন সৈনিক বিদ্রোহ করত তবে তার কোর্ট মার্শাল কেউ ঠেকাতে পারত না। তাই সবাইকে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় চট্টগ্রাম অষ্টম বেঙ্গলের মেজর জিয়াসহ বাঙালী কর্মকর্তারা ২৫ মার্চ রাত ২টা পর্যন্ত সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসসহ পাকবাহিনীর প্রত্যক্ষ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন রাত দুটা নাগাদ। তবে তার ট্রুপস কালুর ঘাট রেখে তিনি ৩০ মার্চ ভারতের ত্রিপুরার চলে যান। অন্যদিকে মেজর শফিউল্লাহ ছিলেন জয়দেবপুরে এবং খালেদ মোশারফ কুমিল্লায় কর্মরত অবস্থায়। এরা প্রথম পর্বেই যথাক্রমে- ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। মেজর মঞ্জুর, মেজর তাহের এবং মেজর জিয়া উদ্দিন এরা পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আগস্ট (১৯৭১) মাসে। মেজর তাহের ফাঁসি দেন জিয়া, জিয়া হত্যার প্রথম শিকার মঞ্জুর আর মেজর পরে লে. ক. জিয়াউদ্দিন, বীর উত্তম খেতাব নিয়ে জামায়াত নেতা (কক্সবাজার)। পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে প্রায় ১ কোটি বাঙালী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারত এদের আশ্রয়-আহার-অস্ত্র দেন। প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াও কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, সেক্টর কমান্ডারদের হেডকোয়ার্টার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী কর্মকা- ভারতের মাটিতেই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে যদিও মার্কিন জনগণ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই ভারতকে সুকৌশলে এগুতে হয়েছে। পাকবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোষরদের হাতে অবরুদ্ধ জীবন হানির আশঙ্কায় ভীত সন্ত্রস্ত এই ভূখ-ের মুক্তিকামী বাঙালী জনগণের কাছে গোটা ৯ মাস সময়ই “ভারত কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না-প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে পাকবাহিনীর হাতে থেকে উদ্ধারে কেন বিলম্ব করছে?” প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের চাপ ছিল ভারতের উপর। কিন্তু ভারতের জন্য ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। ভারতের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। সামরিক দিক থেকে ভারত সুসজ্জিত হলেও পাকবাহিনী ছিল সুদক্ষ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ষাটের দশকে ভারত-চীন এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫) পরে আরকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভারতের জন্য ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এমনি পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিচক্ষণতা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং কূনীতির এক উজ্জলদৃষ্টান্ত। ভারত গোটা বিশ্বে চাপ সৃষ্টি করে দৃশ্যত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাঁর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ ছাড়াই “বাংলাদেশের ঘোষিত স্বাধীনতার” প্রেক্ষাপটে পাকবাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তির ইস্যু সামনে নিয়ে সচেতনভাবে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য সর্বক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিয়েছিল। (চলবে)
×