ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পানির গতি, মাটির প্রকৃতি মাছের মেজাজ- সবই বিবেচনায় রয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

পানির গতি, মাটির প্রকৃতি মাছের মেজাজ- সবই বিবেচনায় রয়েছে

‘পানির গতি, মাটির প্রকৃতি, মাছের মেজাজ-সবই বিবেচনায় নিয়ে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। কাজ শুরু হয়ে গেছে। এগিয়ে চলছে। স্বপ্নের সেতুর জন্য আর মাত্র চারটি বছরের অপেক্ষা। পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক।’ বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা, খ্যাতিমান প্রকৌশলী শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। পদ্মা প্রমত্ত, আমাজনের পর এটিই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পানির স্রোত। একটি স্রোতস্বিনী নদীর মাঝখান দিয়ে সেতু বয়ে নিয়ে যাওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ, সে চ্যালেঞ্জ নির্মাণের, সে চ্যালেঞ্জ নদী শাসনের। পদ্মার মাটি নরম, এখানে তলদেশে যে কোন মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় বড় বড় খাদ, সেই খাদের কথা মাথায় রেখে নদীকে বশে আনার কাজ রয়েছে। পদ্মার এই সেতু এলাকা দিয়ে প্রতিসেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি বয়ে যায়, সেই প্রবাহ অবাধ রাখা একটি বড় কাজ। আর পদ্মার ইলিশের স্বাদ গোটা বিশ্বে পরিচিত, সেই স্বাদের মাছ গভীর পদ্মায় ধরা পড়ে। মাছেদের মেজাজ যেন বিগড়ে না যায়, ওরা যেন যেমন আসছে তেমনই আসতে পারে, ধরা পড়তে পারে পদ্মার জেলেদের জালে সেও কিন্তু কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়, বললেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। দীর্ঘ অঙ্ক কষে বাংলানিউজকে তিনি দেখালেন পদ্মার নিচের পানির স্রোতের হিসাব নিকাশ। প্রকৌশল বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা ঢেলে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের এই অন্যতম শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ। দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো। এসব তো কাজ শুরুর পরের চ্যালেঞ্জ। তবে কাজ শুরুর আগের বাধাগুলো সফলভাবে অতিক্রম করে এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে জানালেন তিনি। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। আমার দৃষ্টিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল সেতুর নির্মাণ কাজ আর নদী শাসন। আমাদের মনে রাখতে হবে, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত স্রোত পদ্মায় প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। এত পানির প্রবাহ দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর পরে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। সেতুর বয়সকাল ১০০ বছর ধরে এটি নির্মাণ করা হবে, তবে আমাদের প্রত্যাশা এটি টিকে থাকবে আরও দীর্ঘকাল ধরে। সেতুর নিচে ভরা মৌসুমে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রতিসেকেন্ডে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। আর সে কারণেই একেকটি পিলারের মাঝখানে ১৫০ মিটার দূরত্ব রাখা হচ্ছে। যমুনা সেতুতে নদীর পানির প্রবাহ যতটা আটকে দেয়া হয়েছে, পদ্মায় প্রবাহ তার চেয়ে অনেক কম বাধাগ্রস্ত হবে, জানান এই প্রকৌশলী। তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যমুনায় ভরা মৌসুমে নদী বিস্তৃত হতো ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত, যা আটকে দিয়ে ৪.৫ কিলোমিটার সেতু দিয়ে বন্ধন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পদ্মার যে এলাকা দিয়ে সেতু তৈরি হচ্ছে সেখানে ভরা মৌসুমে নদীর বিস্তৃতি ১০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পানির প্রবাহ কম ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়টি মাথায় রেখেই এই সেতু টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৬.১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। সেতু নির্মাণের পরে যমুনার তুলনায় পদ্মার পানির অনেক স্বস্তিতে থাকবে, অভিমত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর। তিনি বলেন, আমরা জানি, নদীর এই বেল্টে মাটি খুবই নরম। এর ওপর পড়বে মূল সেতুর ভার। রেল ও রোড ট্রাফিকে ট্রেন-গাড়ির চাপ যুক্ত হবে, তাও গিয়ে পড়বে ওই নরম মাটির ওপর। স্বাভাবিক অবস্থায়ই নরম মাটি চাপ সইতে পারে না, এছাড়াও তলদেশে যে কোন সময় ক্ষয়ের সৃষ্টিও হতে পারে, ভূমিকম্পের কারণে হতে পারে বড় ধস। একেকটি ক্ষয়ে ৬২ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যায় পদ্মার গভীরে যা প্রায় ২০ তলা উঁচু ভবনের সমান। এমন অবস্থায় প্রতিটি পাইল ১১৮ মিটার গভীর পর্যন্ত পুঁতে দিতে হবে। খ্যাতিমান এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, কঠিন কাজটি হচ্ছে এই পাইলগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়া। এ জন্য খোঁজ নিয়ে বিশ্বে একটি মাত্র কোম্পানি পাওয়া গেল যারা এই কাজে দক্ষ। এটি জার্মানির একটি কোম্পানি। ওরা এরই মধ্যে পাইল বসানোর জন্য বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সবচেয়ে ভারি হাইড্রোলিক হ্যামার তৈরির কাজ শুরু করেছে। ওই হ্যামার দিয়েই পদ্মার গভীরে পুঁতে দেয়া হবে ২৫০টি পাইল। এটিও নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বলেন তিনি। পাঁচটি প্রধান প্যাকেজে ভাগ করে কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কাজ ১৫০ কোটি ডলার (প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে মূল সেতু নির্মাণ। আর ১০০ কোটি ডলার (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে নদী শাসন। সঙ্গে রয়েছে তিনটি অপেক্ষাকৃত ছোট প্রকল্প। যার মধ্যে অন্যতম এ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ। মাওয়া অংশে কেবলই সড়ক তবে জাজিরা অংশে রয়েছে সড়কের পাশাপাশি আরও অন্তত পাঁচটি সেতু নির্মাণের কাজ। এই সেতুগুলোও কম বড় নয়, বলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। এর বাইরে বিশাল এই কর্মযজ্ঞের প্রয়োজনেই গড়ে উঠছে অফিস ভবন, আবাসন। আর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। স্থানীয়ভাবেই কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করে এই কাজগুলো সুসম্পন্ন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। আর মূল সেতুর জন্য মালামাল আসতে শুরু করেছে। নদী তীরে মাটি পরীক্ষার কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক, বলেন প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা। কারিগরি দিক ব্যাখ্যার পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন দেশের এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন, পদ্মা ব্রিজের নকশায় নদীর ইলিশের কথাও বিবেচনা করা হয়েছে। পদ্মায় ধরা পড়ে দেশের সবচেয়ে স্বাদের ইলিশ। আর তা বিপুল সংখ্যায়। ইলিশ মাছের আনাগোনা যাতে খুব কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখানে বড় বড় কনস্ট্রাকশনের কাজ চলবে। কিন্তু কাউকেই এমন কোন আচরণ করতে দেয়া হবে না যাতে মাছ চলে যেতে পারে, বলেন তিনি। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, সকল দিক বিবেচনায় আমি অত্যন্ত খুশি, বিশাল এই প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক। আমি আশাবাদী আগামী চার বছরের মধ্যেই আমরা এই সেতু যান চলাচলের জন্য চালু করতে পারব। আর তার মধ্য দিয়েই পূরণ হবে কোটি মানুষের স্বপ্ন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিকের সমন্বয় কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে? প্রশ্নে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, আমি স্পষ্টভাবেই মনে করি সরকারের এই রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তরিকতার এতটুকু অভাব নেই। আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই প্রকল্পের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, এমন একটু সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লেগে যায়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই এমন যে, এতে সরকার পাল্টে যায়। কিন্তু কেউই এ ধরনের প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করে না। যমুনা সেতুর উদাহরণ তুলে ধরে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এরশাদ সরকার এই সেতুর প্রথম উদ্যোগ নেয়, খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে উদ্বোধন করেন। অর্থনৈতিক দিক ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থছাড়ও দেয়া হয়েছে। এটি একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সেতু বাস্তবায়নের অর্থ যোগানের চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি এর কারণে অন্য কিছু খাত গুরুত্বের দিক থেকে পেছনে পড়েও যেতে পারে। তবে সে বিষয়টি খুব বড় করে দেখার কোন কারণ নেই, মত দেন তিনি। জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এই সেতুর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিকটিই হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন। সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এর পর বাংলাদেশীদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ আর থাকবে না। একটি আস্থা তৈরি হবে, এত বড় প্রকল্প আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারি। আর সর্বোপরি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশ্ব দেখবে বাংলাদেশ কি পারে।
×