ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনেকেই আজও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাননি

রাজারবাগের সেই সব বীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

রাজারবাগের সেই সব বীর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ যাঁদের বীরত্বের কারণে বাংলাদেশ পুলিশ স্বাধীনতা পদক-২০১১ পেয়েছেন, সে সব বীরদের অনেকেই আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। এমনকি বিশেষ বীরত্বের স্বাক্ষর রাখার পর আজও কারও কপালেই খেতাব জোটেনি। বিশেষ বীরত্বের জন্য ৩৬ জনকে পুলিশের তরফ থেকে সম্মানিত করা হয়েছে। অনেকের কপালে তাও জোটেনি। সম্মান ও বীরত্বের স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ স্বাধীনতাবিরোধীদের কারসাজি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যকে সার্ভিস বুকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের নাম উল্লেখ করতে দেননি। উল্লেখ করলেও অনেক সময় কেঁটে দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের আগেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। যে কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা পদক-২০১১ পেয়েছে পুলিশ ॥ ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ২৫ মার্চের কালরাতে পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়ে। প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের কারণেই বাংলাদেশ পুলিশকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। সেই প্রতিরোধযুদ্ধের বীরসেনানী ছিলেন অনেকেই। তাদেরই একজন প্রয়াত সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন। যিনি প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের কারণে প্রশংসিত হয়েছেন। যাকে পাকিস্তানী সেনারা নির্যাতনের সময় মর-তাজা বলে ডাকত। তাঁর এক লেখায় সে দিনের নানা ঘটনার প্রকাশ পায়। ওই লেখায় তিনি জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যার আগে সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে রাতেই ঢাকায় আর্মিরা হামলা চালাতে পারে বলে জানান। এ খবরে বাঙালী পুলিশ সদস্যরা হামলা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে ৪০টি সশস্ত্র সেনাভর্তি ট্রাক পুরান এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে শহরের দিতে এগোতে থাকে। কয়েকটি ট্রাক রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে যায়। পাক সেনারা পুলিশ লাইনের পশ্চিমে মালিবাগ ও শান্তিনগর মোড়ে এবং শাহজাহানপুর ও ফকিরাপুল এলাকায় অবস্থান নেয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যরা শাবল দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করে আর ম্যাগাজিন গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। অস্ত্রসহ রাজারবাগের বিভিন্ন ভবনের ছাদে, কার্নিশে, গলিতে, রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেন। রাত ১২টার আগেই পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মালিবাগের দিক থেকে প্রথম আক্রমণ চালায়। প্রতিরোধে গর্জে উঠে বাঙালী পুলিশ সদস্যদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল। বহু পাক সেনা হতাহত হয়। হতাহতদের ট্রাকে উঠিয়ে দ্রুত পিছু হটে পাক সেনারা। এরপর পাক সেনারা ট্যাঙ্কসহ ভারি অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হন বহু পুলিশ সদস্য। রিজার্ভ অফিসের সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। রাত ৩টার দিকে রাস্তার পাশে থাকা ইপিআরপির (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট পুলিশ) ৫টি টিনশেড ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্যারাকে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে শহীদ হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এভাবেই প্রতিরোধযুদ্ধ চলে। এরপর পাক সেনারা ট্যাঙ্কের সহায়তায় পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকে পুরো লাইন ঘিরে ফেলে। ‘নারায়ে তকবীর-আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে দিতে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানী পতাকা উড়ায় পাক সেনারা। আর পৈশাচিক আনন্দে রাজারবাগে নারকীয় তা-ব চালায়। এ সময় বহু পুলিশ সদস্য সাধারণ পোশাকে ছদ্মবেশে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের অনেকেই বিভিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বা ভারতে বা নিজ এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন লিখেনÑ তিনিও পাক সেনাদের নির্যাতনের পর বন্দীদশা থেকে পালিয়ে পুরানা পল্টনে এক আত্মীয়র বাসায় এক মাস ২৩ দিন আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর ছদ্মবেশে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে পালিয়ে রাজশাহী হয়ে ভারতে যান। যোগদান করেন কলকাতা পুলিশ সদর দফতরে। সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনের কৌশল ও পরিকল্পনা সম্পর্কিত অতিগোপনীয় কার্যক্রমে অংশ নেন। প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ বীরত্ব দেখানো ৩৬ জনকে সম্মানিত করা হয় বাংলাদেশ পুলিশের তরফ থেকে। বিশেষ বীরত্ব দেখানো ৩৬ জনের মধ্যে শহীদ হন ৭ জন ॥ এরা হচ্ছেনÑ কনস্টেবল মোরশেদ আলী, পিতা মৃত মনির উদ্দিন, বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানাধীন ধরা এলাকার চরমাদাখালি গ্রামে। কনস্টেবল হাসান আলী, পিতা মৃত ইসমাইল, বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানাধীন মির্জাপুর উত্তরপাড়া এলাকার খাঁনপাড়া গ্রামে। কনস্টেবল আব্দুস ছালাম মোল্লা, পিতা মৃত ইছাহাক মোল্লা, বাড়ি ফরিদপুর জেলা সদরের ঝিলটুলীর মবুলমঞ্জিলে। এসআই (উপ-পরিদর্শক) আব্দুল জলিল বিশ্বাস, পিতা মৃত আব্দুল কাদের বিশ্বাস, বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানাধীন কালীবাড়িতে। কনস্টেবল হারুন মিয়া, পিতা মৃত চাঁন মিয়া, বাড়ি ফরিদপুর জেলার কানাইপুর থানাধীন কমলেশ্বরদী হাইস্কুল এলাকার কমলেশ্বরদী গ্রামে। কনস্টেবল আবুল হোসেন মোল্লা, পিতা মৃত আব্দুল বারিক মোল্লা, বাড়ি রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন মাদারটেকের বাসাবোর আদর্শপাড়ার ১৬৬/২১/এ নম্বরে। কনস্টেবল ইউসূফ আলী মৃধা, পিতা মৃত লাল মোহাম্মদ মৃধা, বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ থানাধীন গাজীপুরা স্কুল এলাকার বৈদ্যপাশা গ্রামে। ৩৬ জনের মধ্যে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন ৭ জন ॥ এরা হচ্ছেনÑ কনস্টেবল থেকে এসআই হিসেবে অবসরে যাওয়া শাহজাহান হাওলাদার, পিতা মৃত মীর্জা আলী হাওলাদার, বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানাধীন সিডা আমিনবাজার এলাকার সিডা গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হিসেবে অবসরে যাওয়া নুরুজ্জামান মিয়া, পিতা মৃত আছমত আলী, বাড়ি ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন ব্যাংক কলোনির ‘ই’ ব্লকের ৭ নম্বর হাসিনা মঞ্জিলে। কনস্টেবল ইউনূস মিয়া, পিতা আমজেদ মিয়া, বাড়ি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানাধীন বনগ্রাম এলাকার বানেশ্বদ্দীতে। কনস্টেবল থেকে এসআই (নিরস্ত্র) হিসেবে অবসর নেয়া নারায়ণ চন্দ্র রায়, পিতা স্বর্গীয় শ্যামাপদ রায়, বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানাধীন নওপাড়ায়। সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন, পিতা মৃত আলহাজ ইয়াকুব আলী, বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বালিয়াডাঙ্গী গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা- ৪৪৪, দক্ষিণ পাইকপাড়া, মিরপুর, ঢাকা। কনস্টেবল আজমল মিয়া, পিতা সফিক উল্লাহ, বাড়ি হবিগঞ্জ জেলা সদরের পোপায়া এলাকার রতনপুর গ্রামে। কনস্টেবল মহিউদ্দিন, পিতা মৃত জয়দে আলী, বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন লামকাইন গ্রামে। ৩৬ জনের মধ্যে জীবিত আছেন ২২ জন ॥ এরা হচ্ছেনÑ কনস্টেবল থেকে এসআই হিসেবে অবসরে যাওয়া জহিরুল হক জহির, পিতা আব্দুর রশিদ মৃধা, বাড়ি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানাধীন বড়কাজুলী এলাকার শেখরকান্দি গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এএসআই হওয়া শেখ আকরামুজ্জামান, পিতা মৃত সফির উদ্দিন, বাড়ি গোলাপগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ফুকরা গ্রামে। কনস্টেবল থেকে নায়েক হওয়া জয়নাল আবেদীন মোল্লা, পিতা মৃত আব্দুল মাজেদ মোল্লা, বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলা সদরের চন্দ্রদীঘলিয়া গ্রামে। কনস্টেবল থেকে নায়েক হওয়া জহুরুল হক কাজী চুন্নু, পিতা মৃত ইসমাইল কাজী, বাড়ি গোলাপগঞ্জ জেলা মকসুদপুর থানাধীন আদমপুর গ্রামে। কনস্টেবল সাহেব আলী মোল্লা, পিতা মৃত বজলুর রহমান মোল্লা, বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলা সদরের চন্দ্রদীঘলিয়া এলাকার চর সুকতাইল গ্রামে। কনস্টেবল গিয়াস উদ্দিন, পিতা আলী আহম্মদ, বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানাধীন খুরশীমুলমাদান এলাকার গোড়াউতরা গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হওয়া শাহজাহান মিয়া, পিতা মৃত সরত আলী, বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানাধীন চিরাংবাজারের বাট্টা গ্রামে। কনস্টেবল থেকে হেডকনস্টেবল হওয়া আব্দুল আলী খান, পিতা মৃত রিয়াছত আলী খান, বাড়ি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ থানাধীন চিকাজানি গ্রামে। কনস্টেবল থেকে হেডকনস্টেবল হওয়া আবু শামা (সামাদ), পিতা আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া, বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর থানাধীন ওসমানপুর এলাকার পীরপুর গ্রামে। কনস্টেবল থেকে হেডকনস্টেবল হওয়া বাবর আলী, পিতা মৃত জসিম উদ্দিন, বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানাধীন সাগরদীঘি গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হওয়া আব্দুল মালেক, পিতা মৃত ইসমাইল, বাড়ি চট্টগ্রাম জেলা সদরের দামপাড়া এলাকার পঞ্চাশ লালখানবাজার গ্রামে। কনস্টেবল থেকে হেডকনস্টেবল হওয়া জয়নাল আবেদীন, পিতা শহীদ আহাম্মদ, বাড়ি চট্টগ্রামের মীরসরাই থানাধীন কাঁটাছড়া গ্রামে। কনস্টেবল থেকে হেডকনস্টেবল হওয়া মাকসুদ আলী, পিতা মৃত ফজর আলী, বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানাধীন বরকইটবাজার এলাকার পূর্ব রামচন্দ্রপূর গ্রামে। নায়েক থেকে পরিদর্শক হওয়া আবুল ফারুক, পিতা মৃত মুন্সী আব্দুর রহমান, বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা থানাধীন জমশেরপুর এলাকার বমীদ গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হওয়া আবুল কালাম আজাদ, পিতা মৃত আব্দুল হাকিম, বাড়ি নোয়াখালী জেলার সুধারামপুর থানাধীন শিবপুর এলাকার সালেপুর গ্রামে। কনস্টেবল আবু সাইদ, পিতা ডা. মোক্তার মল্লিক, বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানাধীন পাইকোসা এলাকার বাগবাড়ি গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হওয়া কাঞ্চন আলী মিয়া, পিতা মৃত তাছেন উদ্দিন মিয়া, বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর থানাধীন কেশবকাঠি গ্রামে। হেডকনস্টেবল মতিয়ার রহমান, পিতা মৃত আজাদ আলী আকন, বাড়ি বরিশাল জেলা সদরের মাধবপাশা এলাকার কেশবকাঠি গ্রামে। কনস্টেবল থেকে এসআই হওয়া শাহজাহান মিয়া, পিতা মৃত এসকেন্দার আলী, বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী থানাধীন চন্দ্রহারা এলাকার সিঙ্গা গ্রামে। কনস্টেবল আব্দুল মালেক খান, পিতা আব্দুল হামিদ খান, বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানাধীন সিদ্ধকাঠি এলাকার খিরাকাঠি গ্রামে। কনস্টেবল আব্দুল মতিন তরফদার, পিতা মৃত মাহতাব উদ্দিন তরফদার, বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানাধীন চাটপাড়া গ্রামে। কনস্টেবল আব্দুর রহমান, পিতা মৃত সফিক উদ্দিন সরকার, বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানাধীন ভবানীপুর গ্রামে। প্রত্যক্ষদর্শী সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেনের স্ত্রীর স্মৃতিচারণ ॥ নাইমা আক্তার (৬০) সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, পাক সেনারা রাজারবাগের চারদিকে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। আমি তখন দুই মেয়ে নাসরিন মোর্শেদ (৫) ও আইরিন মোর্শেদকে (৩) নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অফিসার স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস করছিলাম। রাত ১০টার দিকে আমরা পুলিশ লাইন লাগোয়া এক সাধারণ ব্যক্তির টিনশেড বাসায় অবস্থান নেই। ওই বাড়িতে অন্তত ২৫-৩০ জন আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের অধিকাংশই পুলিশ সদস্যের স্ত্রী সন্তানাদি। রাত ১২টার আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। চারদিক থেকে শুধু বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছিল। মাঝে মধ্যে বিকট শব্দ হচ্ছিল। পরবর্তীতে জানতে পারি, সেসব মর্টারশেল ছুড়ছিল পাক সেনারা। গুলির শব্দে পুরো এলাকায় প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল লাখ লাখ গুলি হচ্ছে। আর বৃষ্টির মতো গুলি পড়ছে আমাদের ওই টিনশেড বাড়ির চালে। চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। জানালার পর্দা ভেদ করে সে আলোতে ঘর আলোকিত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমার স্বামীর কোন হদিস নেই। তিনি আর আমাদের দেখতে আসছেন না। তিনি বেঁচে আছেন না শহীদ হয়েছেন, তারও খবর পাচ্ছি না। দুই মেয়ে আর আমি ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কান্নাকাটি করছি। আমার বড় মেয়ে ভয়ে খাটের নিচে গিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করছিল। রাত সাড়ে ৪টার দিকে আমার স্বামী রক্তাক্ত জখম অবস্থায় ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে আমাদের বাসায় আসেন। এরপর আমরা প্রায় এক মাস ঢাকাতেই আত্মগোপনে ছিলাম। এরপর আমি দুই মেয়ে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের বালিয়াভাঙ্গী পিতা ইয়াকুব আলীর বাড়িতে চলে যাই। পরবর্তীতে আমার স্বামী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তারপর আমার স্বামী আবার পুলিশে যোগদান করেন। এসপি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, অথচ আজও আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী সনদ পাননি। যদিও বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা মহানগর পুলিশ, পুলিশ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বামীর পক্ষে আমি সম্মাননাপত্র ও সনদ গ্রহণ করেছি। এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক ধন্যবাদ। শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বামীর ন্যূনতম কোন খোঁজখবরও নেয়নি পুলিশ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা লাভ করলে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বামীর খোঁজখবর শুরু হয়। পুলিশ স্বাধীনতা পদক লাভ করলে স্বামীর পক্ষে আমি সম্মাননা গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, যাঁদের বীরত্বের ওপর ভর করে বাংলাদেশ পুলিশ স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেছে, তাদেরই অন্যতম আমার স্বামী আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। আমার স্বামীকে যাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারীভাবে সনদপত্র দেয়া হয়, এজন্য রাজারবাগে পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগে দরখাস্ত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করছে শোনে ভাল লাগছে। বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদের বক্তব্য ॥ সংগঠনটির সভাপতি শাহজাহান মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, পরিষদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২শ’। এরা বাংলাদেশ পুলিশের হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে রাজারবাগে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের সময় সেখানে খাতাকলমে ৭শ’ থেকে ৮শ’ পুলিশ সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় দেড়শ’ পুলিশ সদস্য ছুটিতে ছিলেন। প্রায় দেড় শতাধিক শহীদ হন। আর পরদিন ২৬ মার্চ দেড় শতাধিক পাক সেনাদের হাতে বন্দী হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। বাকি ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ পুলিশ সদস্য বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এদের মধ্যে আবার স্বাধীনতাবিরোধী কিছু পুলিশ সদস্য ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। তিনি বলেন, প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের স্বাক্ষর রাখা ৩৬ জনের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারীভাবে স্বীকৃতি পাননি। এমনকি কেউ আজও খেতাব পাননি। তাদের একজন সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন। তার স্ত্রীর অভিযোগ সত্য। তিনি বলেন, আমি প্রতিরোধযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেই। আমিই প্রথম রাজারবাগের ওয়্যারলেস থেকে সারাদেশে বার্তা পাঠাই। রাজারবাগ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সে সংক্রান্ত স্মৃতি আজও জ্বল জ্বল করছে। স্বাধীনতার পর আমি বঙ্গভবনের ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে যোগ দেই। বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে নেন। অথচ আজও আমার কপালে কোন খেতাব জুটেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন, শহীদ কনস্টেবল হাসান আলীর বড়ভাই ইদ্রিস আলী, শহীদ কনস্টেবল হারুণ মিয়ার বড়ভাই ইউসুফ মিয়া, কনস্টেবল থেকে পরবর্তীতে এসআই হিসেবে অবসর নিয়ে মৃত্যুবরণ করা শাহজাহান হাওলাদারের বড়ভাই আব্দুর রাজ্জাক। জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল গিয়াস উদ্দিনের অভিযোগ, তাকে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র দেয়া হয়েছে, যা খুবই আফসোসের। অভিযোগকারীরা বলেন, এদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সনদ পান না। অথচ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সনদ নিয়ে সরকারী চাকরি করছে। প্রমোশন বাগিয়ে নিচ্ছে। সরকারী সব সুবিধা পাচ্ছে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক জহির অভিযোগের সতত্যা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত গাফিলতি ও অজ্ঞানতাসহ নানা কারণ এর জন্য দায়ী। এর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদেরও বিশেষ চক্রান্ত রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করা পুলিশ সদস্য, পুলিশে যোগ দেই, তাদের নানাভাবে স্বাধীনতাবিরোধীরা বিব্রত করেছে। তারা আমাদের সার্ভিস বুকে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম উল্লেখ করতে নিষেধ করে। কারণ জানতে চাইলে তারা নানা অসুবিধার কথা বলে। তাদের ও পরিবার পরিজনের অসুবিধা হতে পারে বলেও আমাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য তাদের তৎপরতার কারণে সার্ভিস বুকে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম উঠাতে পারেননি। এমনকি অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম উঠালে স্বাধীনতাবিরোধীরা কেটে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও অনেক পুলিশ সদস্যকে সাধারণ পুলিশ সদস্য হিসেবে সার্ভিস বুকে নাম তুলতে বাধ্য করেছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমল পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধীরা নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়েছে। তাদের সৃষ্টি করা নানা জটিলতার কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পাননি। পুলিশের বক্তব্য ॥ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রাজারবাগ দফতরের কল্যাণ শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, অনেক শহীদ, পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করা এবং জীবিত অনেক পুলিশ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি পাননি। এ সংক্রান্ত অন্তত ১৮টি দরখাস্ত তাদের দফতরে জমা পড়েছে। অনেকেই এ সংক্রান্ত তথ্য জেনে নিতে তাদের দফতরে যোগাযোগ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আরও দরখাস্ত জমা পড়বে। জমা পড়া দরখাস্তগুলো পুলিশ সদর দফতরের কল্যাণ শাখায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও ২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আজীবন রেশন দেয়ার তালিকা প্রস্তুতির কাজ চূড়ান্ত হয়েছে। রাজারবাগ কল্যাণ শাখার সহকারী পুলিশ কমিশনার সৈয়দ মামুন মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য অনেক দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেসব দরখাস্ত পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা এবং অনেক জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি এ সংক্রান্ত তথ্য জেনে যাচ্ছেন। তাঁরা দরখাস্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশের সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার অনেক দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেসব দরখাস্ত যাচাই-বাছাই চলছে। যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র পাননি, তাঁদের বিষয়ে পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ॥ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি পুলিশের এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুবই কম। তারপরও যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বীকৃতি পাননি, তাঁদের আবেদন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই সনদপত্র পাবেন। তাতে কোন সন্দেহ নেই। সরকার সে বিষয়ে শতভাগ আন্তরিক। বর্তমান সরকারের উদ্যোগ ॥ স্ব^াধীনতার ৪৩ বছর পরও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় হয়নি। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথমবারের মতো একটি তালিকা করে। তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ‘লাল বই’ নামে সংরক্ষিত আছে। ওই তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার জনের নাম থাকলেও সবার নামে গেজেট প্রকাশিত হয়নি। যাঁদের গেজেট প্রকাশিত হয়নি তাঁদের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কাজ করছে। এদিকে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদেরও অনেকেই ভুয়া বলে অভিযোগ ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে ২০০৯ সালের ১৩ মে থেকে তদন্ত শুরু হয়। এদিকে গত ১৩ অক্টোবর একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা ঠিক করেছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ১ লাখ ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী প্রায় ৫০ হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। দরখাস্তকারী ও অভিযুক্তদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিল অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮শ’ ও অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজার মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮শ’ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের আগেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
×