ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী বিজয়ী জাতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

বাঙালী বিজয়ী জাতি

আমাদের সংবিধানের শুরুটা হয়েছে এভাবে, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।” আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে সংবিধান থেকে ঐতিহাসিক সংগ্রাম শব্দগুচ্ছ বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হিসেবে পরিবর্তন করেন। অর্থাৎ ঐতিহাসিক সংগ্রাম বলতে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের সব সংগ্রামকে অস্বীকার করে জিয়া যেদিন মুক্তিযুদ্ধের লেবাস পরেছিলেন সেই ২৬ মার্চ থেকে ঐতিহাসিক যুদ্ধের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গণনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ। বাঙালীর স্বাধীনতা ও বিজয়ের দিনটিতে পৌঁছতে বাঙালী জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ মুজিবকে পাড়ি দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে ১১ বছর জেল ও দু’বার ফাঁসির মুখোমুখি দীর্ঘ ২৩ বছর ধারাবাহিক আপোসহীন সংগ্রামের পথ। ১৯৪৭ সালে অঙ্কুরিত আটচল্লিশ ও বায়ান্নতে বিস্ফোরিত মায়ের ভাষা বাংলাকে (যা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ নাগরিকের ভাষা) অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম মূলত বাঙালী জাতীয়তাবাদের তথা স্বাধীনতার মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত। এই দাবির পক্ষে গণরায় পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বাংলাভাষাবিরোধী শাসকগোষ্ঠী মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টকে ৯৯ শতাংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু তা নস্যাত করে দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সাল। কিন্তু বাঙালী রাজপথ ছাড়েনি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফার ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’ দাবি বাঙালীর প্রাণের দাবিকে নস্যাত করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিক (১৯৬৬) শুধু আটক করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে বিচারের প্রহসন শুরু করেছিলেন ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির দিকে। আইয়ুব খান ভেবেছিল যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার অভিযোগ আনলে মুজিবের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষেপে যাবে এবং সহজেই তাঁকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়াল এই বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে। ছাত্র সমাজের মুখপাত্র তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহম্মেদের নেতৃত্বে গড়ে উঠল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও তৈরি হলো ৬ দফার পুরোটা নিয়ে ছাত্রদের দাবিসহ ১১ দফা কর্মসূচী। গড়ে উঠল ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, শরিক হলো বাংলার আপামর জনসাধারণ। মওলানা ভাসানী, যিনি আইয়ুব দশকের পুরো অংশটিতে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’, ৬ দফা ‘সাম্রাজ্যবাদের দলিল’ এমনকি ৭ জানুয়ারি ’৬৯ তারিখে ১১ দফাকেও প্রথমে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহম্মদ ও খালেদ মোহাম্মদ আলীর কাছে অবশ্য সমর্থন জানান। ২৪/১/৬৯ তারিখে (সেদিন কার্ফু ছিল) এবং তাঁকেও আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পল্টনে বলতে হয়েছিল, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র নেতা আসাদ, আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হককে বন্দী অবস্থায় গুলি করা হয় (জহুর সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন এবং ফজলুল হক গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে শহীদ এবং মহিলাসহ অগণিত বাঙালীর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং বেতার/টিভিতে নিজে আগামীতে আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা (মোট ৩৪ জন) মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (৬৯) রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনার সভাপতি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহম্মদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দানের প্রস্তাব করেন এবং সমবেত জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করে। যে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল তাকেই অবশেষে পদত্যাগ করে (২৪ মার্চ ’৬৯) ক্ষমতা দিতে হয় সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া খান সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পাকিস্তানের গণ ও জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দিন ধার্য্য করেন যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ ও ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭১। উল্লেখ্য, বংঙ্গবন্ধু ইতোপূর্বে গৃহীত ‘প্যারিটি’ (জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব) প্রত্যাখ্যান করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব আদায় করে নিয়েছিলেন। ফলে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের (মহিলাদের জন্য আলাদা ১৩টি আসন) মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ দাঁড়ায় ১৬২+৭=১৬৯ ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৮+৬=১৪৪টি আসন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি এবং মহিলা আসন ৭টিসহ মোট ১৬৯টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ২৮৮ এবং মহিলা ১০টি আসনসহ ২৯৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৫টি মহিলা আসনসহ লাভ করে ৮৮টি আসন। যে বিধান (এলএফও) বলে নির্বাচন হয়েছিল তাতে একথা নির্দিষ্ট ছিল না যে, সংবিধান প্রণয়নে ২/৩ শতাংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হবে। উক্ত বিধানে বলা হয় যে, সংসদ বিষয়টি নির্ধারণ করবে। তাই একথাই স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছেন সেহেতু তিনি সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম। সত্তরের নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু ছ’দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভুট্টো প্রকাশ্যে “বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ভোট দেয়নি, ছয়দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র গ্রহণযোগ্য নয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তাঁর কাছে ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা শেখ মুজিবের কাছে হস্তান্তরের মতো উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখতে শুরু করেন, যার ফলে সংসদ অধিবেশন বসতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি ’৭১ এক ঘোষণায় জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন ৩ মার্চ (৭১)। ভুট্টো তাতে যোগদান করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। ভুট্টো ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসা শুরু করেন কিন্তু হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ দুপুরে বেতারে প্রচারিত এক ঘোষণায় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে পড়ে বিক্ষোভে। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সদস্যদের বলেন, ‘আজ যে কথা আপনাদের বলব তা স্ত্রীকেও বলবেন না। ইয়াহিয়া সৈন্য আনছে, আমিও আমার পথে যাব। এলাকায় চলে যান। জনগণকে সংগঠিত করে প্রস্তুত রাখুন যে কোন ত্যাগের জন্য।’ জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘উই কানট এলাউ ইট টু গো আন চ্যালেঞ্জড’ এখান থেকে অসহযোগ শুরু। মার্চ মাসের সে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপী হরতাল, মিটিং, মিছিল এবং অফিস, স্কুল-কলেজ বন্ধ। প্রথম সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ কর্তৃক ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পুনরায় উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ৪টি দাবিসহ উচ্চারণ করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,” আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। বস্তুতঃ ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। জনসাধারণের ও সরকারী দফতর জন্য ৭ মার্চ ১১টি, ব্যাংক ও সরকারী সংস্থার জন্য ১০ মার্চ সুস্পষ্ট ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন, যা সরকারী কর্মকর্তারা যথারীতি পালন করে। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর নিয়োগ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শপথ পড়াননি। ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি বেতার/টিভিতে প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা পালনে বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা কর্মবিরতি ঘোষণা করে যার ফলে ৭ মার্চের ভাষণ সেদিন রাতে বেতার/টিভিতে প্রচারে বাধ্য হয়। জনগণের দাবি নস্যাত করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান এবং বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইয়াহিয়া পুনরায় প্রতারণার পথ বেছে নিয়ে ৬ মার্চ বেতার/টিভিতে প্রচারিত ভাষণে সংসদ অধিবেশনের দিন পুনরায় ধার্য্য করেন ২৫ মার্চ। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের নির্দেশ মোতাবেক গ্রামে গঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, পুলিশ-বিডিআর-আনসারের প্রাক্তন সৈনিকদের সংগঠিত ও সামরিক ট্রেনিং দানের কাজ চলতে থাকে এমনকি পাকবাহিনীতে কর্মরত সৈনিক অফিসারদের প্রস্তুত থাকার জন্য যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। মওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টনে ও ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের জনসভায় বলেন, ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, খামোখা কেউ তাকে অবিশ্বাস করবেন না। ২৫ মার্চের মধ্যে কোন কিছু করা না হলে মুজিবের সঙ্গে মিলিয়া তুমুল আন্দোলন শুরু করিব।’ ১৪ মার্চ ’৭১ ভুট্টো করাচীর নিস্তার পার্কের জনসভায় ‘শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক পার্লামেন্টের বাইরে সংবিধান সংক্রান্ত সমঝোতা ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পৃথকভাবে দু’টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে ঢাকায় আসেন কিন্তু তখন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর হাতে। বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিতে হয়েছে। ভুট্টো আসেন ২১ মার্চ। আলোচনা চলে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। মুজিব-ইয়াহিয়া, ভুট্টো-ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠককালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহকর্মী ছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোস্তাক ও ডক্টর কামাল হোসেন। এই সব আলোচনায় বঙ্গবন্ধু প্রতিপক্ষকে বুঝাতে চেয়েছিলেন বাংলার জনগণ জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে তাই স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই এবং তা বিনা রক্তপাতে হলেই তাতে সম্পর্ক ভাল থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আপোসহীনতার স্বীকৃতি পাওয়া যায় ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ থেকে। এতে বলা হয় ‘শেখ মুজিব পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও কায়েদে আজমের ছবি পুড়িয়েছে, প্যারালাল সরকার চালিয়েছে এবং তার কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ঘোষণা আদায় করতে চেয়েছেন। ‘উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু নিজে শুধু জয় বাংলার পতাকা উত্তোলন করেননি বরং যে গাড়ি নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতে যেতেন তাতে শোভা পেত জয় বাংলার পতাকা। ১৯ মার্চ ’৭১ বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে লিখিত এক ইস্তেহারে ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট-বন্দুক- বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধকরা যাবে না, কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত, তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।” কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্তি ঘোষণা না দিয়ে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ (৭১) সন্ধ্যায় করাচী পালিয়ে যান বাঙালীদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে। ভুট্টো অবশ্য ২৬ মার্চ সকালের ফ্লাইটে করাচী পৌঁছে স্বস্তি প্রকাশ করেন, “পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।” ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনী বাঙালীদের উপর শুরু করে বর্বরোচিত গণহত্যা। অসহযোগ আন্দোলন তথা ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু তার জনগণকে পস্তুত করছিলেন সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। ঘটনা প্রবাহের প্রতি তার ছিল তীক্ষè দৃষ্টি। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের পলায়নের খবর পেয়ে ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগের পূর্বেই বিকেল সাড়ে ৬টায় চট্টগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিবেশী একেএম মোশারফ হোসেন (বিএনপি প্রতিমন্ত্রী-২০০১) এবং নঈম গওহর মারফত যে নির্দেশ এম আর সিদ্দিকীর কাছে প্রেরণ করেন তা হচ্ছে “লিবারেট চিটাগাং, টেকওভার এডমিনিস্ট্র্রেশন, প্রসিড ফর কুমিল্লা। এম আর সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যখন পান তখন তার বাড়িতে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যসহ সহকর্মী এম এ মান্নান, এম এ মজিদ, আতাউর রহমান কায়সার, ডা. জাফর, অধ্যাপক খালেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিয়ে পূর্ব পরিচিত সেনাবাহিনীর বাঙালী অফিসার ও সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন। ডা. জাফর যান তৎকালীন ই.পি.আর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের বাসায়। (চলবে)
×