ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজাকাররা আমার বাবাসহ ৪২ জন হিন্দুকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

রাজাকাররা আমার বাবাসহ ৪২ জন হিন্দুকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের অষ্টম সাক্ষী আনন্দ লাল দাশ জবানবন্দীতে বলেছেন, আসামি সিরাজ মাস্টার বাঁশিতে ফু দেয়ার পর রাজাকাররা আমার বাবা মনি লাল দাশসহ ৪২ জন হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া সিরাজ মাস্টার আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথার বাম পাশে আঘাত করেছিল। আর লতিফ তালুকদার আমার বাবা ও আমাকে মারধর করে। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে আংশিক জেরা করেন। পরবর্তী জেরার জন্য আজ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। সাক্ষীকে জবানবন্দীতে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। আসামি পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান। সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম আনন্দ লাল দাশ। আমার বর্তমান বয়স ৬০ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম-আলোকদিয়া, থানা কচুয়া, জেলা বাগেরহাট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ১৭ বছর। ১৮ কার্তিক শুক্রবার ১৯৭১ সালে আমার বাবা মনি লাল দাশ আমাকে বলে যে, তোমাকে আমার সঙ্গে শাকসবজি নিয়ে শাঁখারী কাঠি বাজারে বিক্রি করার জন্য যেতে হবে। আমার বাবা শাকসবজি, তরিতরকারি বাজারে বিক্রি করতেন। ওইদিন বিকেল আনুমানিক ৪টা থেকে সাড়ে চারটার দিকে আমি ও আমার বাবা দোকানদারীর সময় হঠাৎ পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা শাঁখারী কাঠি হাটে আক্রমণ চালায় । ৪০-৫০ জন রাজাকার তখন শাঁখারী কাঠি বাজার ঘেরাও করে ফেলে। রাজাকারদের হাতে রাইফেল ছিল। রাইফেলের মাথায় সাদা লম্বা ধরনের কি যেন লাগানো ছিল। তাদের কোমরে কি যেন বাঁধা ছিল। রাজাকাররা শাঁখারী কাঠি হাটে বাজার করতে আসা অনেক হিন্দু লোককে আটক করে গামছা দিয়ে জোড়া জোড়া করে বেঁধে ফেলে। আমি এবং আমার বাবা ভয়ে আটোসাটো হয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে রাখি। এর মধ্যে কয়েকজন রাজাকার আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখানে এসে আমার বাবা মনি লাল দাশকে মারধর শুরু করে। আমি ওই অবস্থায় আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরলে রাজাকাররা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার মাথার বাম দিকে আঘাত করে। (সাক্ষী তার মাথার বাম পাশের আঘাতের চিহ্ন ট্রাইব্যুনালে দেখান)। যে রাজাকারটি আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিল সে হচ্ছে আসামি সিরাজ মাস্টার। ইতোমধ্যে অপর একজন রাজাকার যিনি হচ্ছেন আসামি আব্দুল লতিফ তালুকদার সেখানে এসে আমার বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানা হেঁচড়া করতে থাকে। সাক্ষী আরও বলেন, আমি আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরি তাকে যেন নিয়ে যেতে না পারে। আসামি আব্দুল লতিফ তালুকদার আমার বাবাকে ও আমাকে মারধর শুরু করে। সেই মারধরের কারণে আমার বাম পায়ে গুরুতর জখম হয়। (সাক্ষী তার পায়ের আঘাতের চিহ্ন ট্রাইব্যুনালকে দেখান)। আমি অন্য কোন রাজাকারের নাম বলতে পারব না। এরপর ওই দুই রাজাকার আমার বাবাকে হাটের পূর্ব দিকে আটককৃত অন্যান্য লোকজনের কাছে নিয়ে তাকেও আমাদের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। তখন আমি দেখতে পাই যে, আটককৃত সকলকেই সেখান থেকে দক্ষিণে খালের পাশে নিয়ে গিয়ে লাইন করে বসায়। এরপর আসামি সিরাজ মাস্টার একটি বাঁশিতে ফু দেয়। ওই বাঁশির শব্দে রাজাকাররা আটককৃতদের উপর গুলি করে। গুলি করা শেষ হলে ওই রাজাকাররা পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার পরে আমার মা হাটে আমার কাছে আসে এবং বাবার কথা জিজ্ঞাস করে। আমি তখন মাকে বলি বাবাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। সম্ভবত তাকে মেরে ফেলেছে। এ সময় আমার মাথা ও পা থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার মা তার শাড়ি ছিড়ে আমার মাথা ও পায়ের ক্ষত স্থান বেঁধে দেয়। আমার মা আমাকে ওই অবস্থায় আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলে আমি বাড়ির বারান্দায় চটের ওপরে শুয়ে পড়ি। এ অবস্থায় দেখি আমার শরীরের পিছন দিকে রক্ত বের হচ্ছে। তারপর বুঝতে পারি যে আমার ঘাড়ে আসামি সিরাজ মাস্টার ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের আঘাতে সেখানে ক্ষত হয়েছে এবং সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। আমার মা ওই ক্ষত স্থান দেখে তখন পান খাওয়ার চুন লাগিয়ে দেয়। ওই চুন লাগার কারণে আমার ক্ষত স্থানে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। আমি ওই চুন সরিয়ে ফেলি। তখন আমার মা দুবলা ঘাস চিবিয়ে আমার পিঠের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিলে ধীরে ধীরে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। ওই ঘটনার এক মাস পরে জানতে পারি যে, আমার বাবসহ যে সব হিন্দুকে ওইদিন হত্যা করা হয়েছিল তাদের রামচন্দ্রপুর গ্রামের বৃষখালী খালের কাছে সবাইকে এক সঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে কবর দেয়া হয়েছিল। আমি শুনি যে এ দিনের ঘটনায় আমার বাবাসহ রাজাকাররা ৪২ জন হিন্দুকে মেরে ফেলেছিল।
×