ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা দোষে কারাবাস ॥ অবশেষে মুক্তি মিলল হাইকোর্টে

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

বিনা দোষে কারাবাস ॥ অবশেষে  মুক্তি মিলল হাইকোর্টে

আরাফাত মুন্না ॥ ‘মাগো আদালত আমারে ছাইড়া দিছে। আমারে ছাইড়া দিছে। আমি অহন তোম্্গ লগেই বাড়ি যামু’ এমনিভাবেই উচ্ছ্বসিত আবেগে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো কিশোরী মেয়েকে বলছিলেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কুচিয়ামোরা গ্রামের মনিরুজ্জামান মনির (৫৫)। ২০০২ সালের লালবাগের বোমা বিস্ফোরণ মামলায় কারাদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি মোঃ মনির হোসেনের (নথি সূত্রে বর্তমান বয়স ৩০) স্থলে নিজের এলাকা থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল মনিরুজ্জামানকে। মুক্তি পেতে তিনি পলাতক মনির হোসেন নন উল্লেখ করে মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার আদালতে একাধিক আবেদনও করেছিলেন। মূল আসামির সঙ্গে বয়সে ২৫ বছরের পার্থক্য থাকার পরও ওই দুই আদালতে মুক্তি মিলেনি তার। কোন অপরাধ না করেই প্রায় আট মাস কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে। পরে মনিরুজ্জামানের স্ত্রীর আবেদনে মামলাটি আসে হাইকোর্টে। অবশেষে হাইকোর্ট তাকে সরাসরি মুক্তি দিয়েছেন। রবিবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এমনই একটি আদেশ দেন। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালের ৩ অক্টোবর রাজধানীর লালবাগ থানার রাজনারায়ণ রোডে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৫ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই দিনই মোঃ মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। মামলার নথিতে গ্রেফতারের সময় মনির হোসেনের বয়স দেখানো হয় ১৮ বছর (বর্তমান হিসাবে আসামির বয়স ৩০) এবং তার পিতার নাম উল্লেখ করা হয় আব্দুল বারেক। এছাড়া তার বর্তমান ঠিকানা হিসেবে লালবাগ উল্লেখ করা হলেও, স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার আলমপুর গ্রাম। নথি সূত্রে জানা গেছে, আসামি মনির হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে উপস্থাপন করা হলে তাকে জামিন দেন আদালত। এরপর থেকেই মনির হোসেন পলাতক। পরে পুলিশ আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। আসামির স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়। এরপর আসামি মনির হোসেনের অনুপস্থিতেই বিচার শেষে ২০০৬ সালের ২ আগস্ট তাকে তিন বছরের কারাদ- দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৮। মামলা সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ এপ্রিল হঠাৎ করেই মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানা পুলিশ সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোরা এলাকা থেকে মনিরুজ্জামান মনির (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। যার পিতার নাম মৌলভী আব্দুল বারী। পরে আটক মনিরুজ্জামান মনিরকে লালবাগের বোমা বিস্ফোরণ মামলার আসামি মোঃ মনির হোসেন উল্লেখ করে মুন্সীগঞ্জ জেলা আদালতে পাঠালে আদালত মনিরুজ্জামানকে কারাগারে পাঠায়। নথি সূত্রে জানা গেছে, কারাগারে পাঠানোর পর মনিরুজ্জামান প্রথমে মুন্সীগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনি সেই মনির হোসেন নন দাবি করে জামিন চান। তবে আদালত তার আবেদনটি নামঞ্জুর করেন। পরে তিনি ওই মামলার রায় প্রদানকারী আদালত ঢাকা মেট্রোপলিটন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৮ এ একইভাবে জামিন চান। ট্রাইব্যুনালও তার আবেদন নামঞ্জুর করেন। জামিন আবেদন নামঞ্জুরের পর তিনি আসামি মনির হোসেন নন, এ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে একটি বিশেষ আবেদন করেন। পরে পলাতক মোঃ মনির হোসেন এবং গ্রেফতার মনিরুজ্জামান মনির একই ব্যক্তি কিনা, তা তদন্তে লালবাগ থানাকে নির্দেশ দেন মেট্রোপলিটন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৮। এরপর লালবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আহসান হাবিব বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পলাতক মোঃ মনির হোসেন এবং গ্রেফতার মনিরুজ্জামানের বয়সের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে এবং মামলা দায়েরের সময় লেখা মোঃ মনির হোসেনের বর্তমান ঠিকানায় খোঁজ করলে মনিরুজ্জামান নামে কেউ থাকত কিনা, ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে এরপরও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মনিরুজ্জামানকে মুক্তি না দেয়ায় তার স্ত্রী সুফিয়া আক্তার স্বামীর মুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন (হেবিয়াসকর্পাস) দায়ের করেন। মনিরুজ্জামানকে ভুল ব্যক্তি হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রাথমিক শুনানির পর গত ২ নবেম্বর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মনিরুজ্জামান মনিরকে কেন মুক্তি দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে এই মনিরুজ্জামান মনির কি পলাতক মোঃ মনির হোসেন কিনা, তা তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এছাড়া গ্রেফতারকৃত মনিরুজ্জামান মনিরকেও আদালতে হাজির করতে বলা হয় আদেশে। আদেশে, স্বরাষ্ট্র সচিব, মেট্রোপলিটন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৮, কারা মহাপরিদর্শক, জেলা প্রশাসক-ঢাকা, পুলিশ সুপার-ঢাকা, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, অফিসার ইনচার্জ লালবাগ থানাকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। জানা গেছে, হাইকোর্টের আদেশের পর গত ২৫ নবেম্বর মনিরুজ্জামান মনিরকে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করা হয়। তবে প্রতিবেদন দাখিল করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। পরে ৩ ডিসেম্বর মনিরুজ্জামানকে হাজির না করে প্রতিবেদন দাখিলে রাষ্ট্রপক্ষ আবারও সময় আবেদন করে। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল এবং মনিরুজ্জামানকে হাজিরের নতুন সময় নির্ধারণ করেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর মনিরুজ্জামানকে হাইকোর্টে উপস্থিত করা হলেও প্রতিবেদন দাখিলে আরও এক দফা সময় আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন আদালত। রবিবারও শুধু মনিরুজ্জামানকে হাজির করে প্রতিবেদন দাখিলে আবারও সময় চায় রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতে মনিরুজ্জামানের স্ত্রীর দায়ের করা আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট জাফর আলীম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, আমরা ওনাকে এখান থেকেই ছেড়ে দিব। এ সময় ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায় বিষয়টির বিরোধিতা করলে আদালত মনিরুজ্জামানকে উঠে দাঁড়াতে বলেন এবং উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা সকলে দেখুন এই লোকটির বয়স কি ৩০ বছর? নাকি ৫৫ বছর। পরে আদালত বলেন, আমরা ওনাকে এখান থেকেই ছেড়ে দিচ্ছি। মনিরুজ্জামানকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, আপনি এখান থেকেই সরাসরি বাড়ি চলে যাবেন। জেলখানায় যেতে হবে না। আমরা আবার শুনানির তারিখ দিলে সেই দিন আসবেন। আদালত ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবেন। এ সময় আদালত মনিরুজ্জামানকে আদালতে হাজিরকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা আর তাঁকে ধরবেন না। তিনি এখান থেকেই চলে যাবেন। পরে এ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আসামি ২২ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করেছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে রিট আবেদনকারী মনিরুজ্জামানের স্ত্রী সুফিয়া আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্ট যে তদন্ত করতে বলেছে, সে অনুযায়ী পুলিশ তদন্তও করেছে। তারা আমাদের বাড়িতে গিয়েছে, আমার স্বামীসহ পরিবারের সব সদস্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়েছে।
×