ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বছরে ১৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা

উত্তরাঞ্চলে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ॥ জ্বালানির রমরমা ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

উত্তরাঞ্চলে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ॥ জ্বালানির রমরমা ব্যবসা

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৩ ডিসেম্বর ॥ উত্তরাঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ লিটার উচ্চমাত্রায় সীসাযুক্ত কনডেনসেট অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনে মেশানো হচ্ছে। ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবহারের ফলে তেলচালিত যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ ঘটছে। এদিকে উচ্চমাত্রায় সীসাযুক্ত কনডেনসেটের (অপরিশোধিত তেল) অবৈধ ব্যবসা করে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বছরে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপিসির বাঘাবাড়ী ডিপো ও জ্বলানি তেল ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের অনুমতি পাওয়া পাঁচটি বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানি ভেজাল মেশানোর এ কাজটি করছে। আর এসব ভেজাল জ্বালানি তেল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অধীন তেল বিতরণ কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানির চোখ এড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের তেল পাম্প, ডিলার ও দোকানদারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্টিবিউটরর্স এজেন্ট এ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন বাঘাবাড়ী ঘাট শাখার একাধিক জানিয়েছে, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মমিন, মন্টু, রফিকসহ কয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড এবং বেসরকারী সুপার রিফাইনারি কোম্পানি, জেবি রিফাইনারি কোম্পানিসহ পাঁচটি রিফাইনারি কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ লিটার উচ্চমাত্রায় সীসাযুক্ত কনডেনসেট এনে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য আলোকদিয়ার গ্রামের মফিজ উদ্দিন, মতিন, অরুন, শাকতোলার আলম, হাফিজ, বাবু, নুকালীর বাবলু শেখ, সেলাচাপরি গ্রামের শাহিনসহ কয়েকজনের কাছে বিক্রি করছে। পরে এই সিন্ডিকেট সদস্যরা ভেজাল জ্বালানি তেল উত্তরাঞ্চলের সাড়ে চাশ’টি তেল পাম্পসহ সহস্রাধিক ডিলারের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা ভেজাল তেলের রমরমা ব্যবসা করে আসছে। শাকতোলা গ্রামের আলম ভেজাল জ্বালানি তেলের ব্যবসার কথা অস্বীকার করে বলেন, সে কোম্পানি থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে ব্যবসা করছে। জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর শাহাজাদপুর থানা পুলিশ বাঘাবাড়ীতে কনডেনসেট ভর্তি তিনটি ট্যাংকলরি আটক করে। পরে জ্বালানি তেল ভেজালকারী চক্রের সদস্যদের তদবিরে ট্যাংকলরি তিনটি ছেড়ে দেয়া হয়। শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান শামীম ইকবাল ট্যাংকলরি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসের সঙ্গে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত কনডেনসেট (গ্যাসের সহজাত ক্রুড অয়েল) বেরিয়ে আসে। রিগ মেশিনে গ্যাস ও কনডেনসেট আলাদা হয়ে যায়। পরে উত্তোলিত কনডেনসেট রিফাইনারিতে রিফাইনের জন্য পাঠানো হয়। গ্যাস ফিল্ডগুলোতে উত্তোলিত কনডেনসেটের সঠিক হিসাব নেই। এ সুযোগে গ্যাস ফিল্ডের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা গোপনে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত কনডেনসেট জ্বালানি তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। জানা গেছে, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনে কনডেনসেট মেশানোর উদ্দেশ্য বেশি মুনাফা করা। এক লিটার কনডেনসেটের দাম ৫০.৫০ টাকা। আর এক লিটার অকটেনের দাম ৯৬.০১ টাকা, পেট্রোল ৯২.১৫ টাকা, ডিজেল ৬৫.৮১ টাকা ও কেরোসিনের দাম ৬৬.৬১ টাকা। অধিক মুনাফার লোভেই জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মেশানো হচ্ছে। যমুনা সেতুতে চেক পোস্ট বসালে পাচার হয়ে আসা কনডেনসেট হাতেনাতে ধরা যাবে বলে বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে। বাঘাবাড়ীতে জ্বালানি তেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে প্রতিদিন দুই লাখ লিটার কনডেনসেট জ্বালানি তেলে মেশানো হচ্ছে। প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে ২৫ টাকা হিসেবে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা লাভ করছে। সেই হিসেবে মাসে ১৫ কোটি টাকা এবং বছরে ১৮০ কোটি টাকা প্রভাবশালী চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে। ভেজাল তেল ব্যবহার করায় যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ ঘটছে। এছাড়া গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের কমপ্রেসারের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কমপ্রেসারের চাপে গ্যাসের গাদ ট্যাংকিতে জমা হয়। সেই গাদ প্রতি লিটার ২২ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা ২২ টাকা লিটারের গাদ পেট্রোলে মিশিয়ে ৯২.১৫ টাকা দরে বিক্রি করছে বলে সূত্রে জানা গেছে। বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলো পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিপিসির পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানি কাছে বিক্রি করবে। এদিকে বিপিসির উত্তরাঞ্চলের বাঘাবাড়ী, পার্বতীপুর, রংপুর, রাজশাহী ও হরিয়ানা অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা কোম্পানি থেকে উত্তরাঞ্চলে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় প্রতিদিন প্রায় ২২ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ অঞ্চলে কনডেনসেট পাচার হয়ে আসায় এই পাঁচটি ডিপোতে জ্বালানি তেল বিক্রি কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বেসরকারী কোম্পানিগুলো জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মিশিয়ে গোপনে বিক্রি করছে এ অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, বিপিসি যখন বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তেল নেয়, তখন সেই তেলের মান পরীক্ষা করে নেয়া হয়। জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ। তিনি জানান, জ্বালানি তেলে ভেজাল নিয়ে গত ৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিপিসি, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক হয়। তবে বৈঠকে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি। জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মেশানোর অভিযোগ সম্পর্কে সুপার রিফাইনারি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলে তার দুটি মোবাইল ফোনে বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টের ব্যবস্থাপক (সমন্বয়) মোঃ নজরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
×