ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুন্দরবনে থালা বাসন ফোম ও কলাপাতা দিয়ে তেল অপসারণ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনে থালা বাসন ফোম ও কলাপাতা দিয়ে তেল অপসারণ

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল এখন ‘থালা-বাসন, ফোম ও কলাপাতা’ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে অপসারণের কাজ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জেলে-বনজীবীসহ গ্রামবাসী বনের নদ-নদী-খাল থেকে তেল সংগ্রহ করে তা বিক্রি করছেন। তবে সরকারী উদ্যোগে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণের কাজে এখনো দৃশ্যত ধীর গতি। নৌ-মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পৃথক দুটি টীম শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনার কারণ এবং জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ সঙ্কট উত্তোরণের বিষয়ে পৃথক এ কমিটি কাজ করছে। সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে গঠিত বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পৃথক তদন্ত কমিটি শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। এদিন সন্ধ্যায় তাঁরা মংলায় সুন্দরবন বিভাগের রেস্ট হাউসের মিলনায়তনে মূল্যায়ন সভায় মিলিত হন। এ টীমের প্রধান বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ নূরুল করিমের নেতৃত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দীলিপ কুমার দত্ত, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিশাখা-(১)-এর উপসচিব সৈয়দ মেহ্দী হাসান, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. সুলতান আহমদ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বাণিজ্যিক) ড. মোঃ রেজাউল হক, বিআইডব্লিউটিএয়ের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক (বিপণন) মীর রেজা আলী, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও, বাগেরহাট পরিবেশ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সরেজমিন পরিদর্শনের পর এ টিমের সঙ্গে থাকা বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র ম-ল জানান, ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের ৬টি চেম্বারের অধিকাংশ তেল বের হয়ে ভেসে গেছে। গত ৩ দিনের জোয়ার-ভাঁটার সঙ্গে এ তেল আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে পরিদর্শনকালে জলজ কোন প্রাণীর মৃতদেহ তাঁরা দেখতে পাননি বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুঃ শুকুর আলী জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন জলজ প্রাণীর মৃত্যুর খবর তিনি পাননি। এদিকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সভা শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শেষ হয়। সভা শেষে এ কমিটির অন্যতম সদস্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমানে যে অবস্থায় তেল ভাসছে তাতে ক্যামিকেল পাউডার না ছিটানোই ভাল। কারণ ভাসমান তেলের ঘনত্ব ওই হারে এখন দেখা যাচ্ছে না। এটি তাঁর ব্যক্তিগত মত বলে তিনি উল্লেখ করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে নদী দূষণ রোধ করতে চট্টগ্রাম থেকে কা-ারি-১০ নামে একটি জাহাজ ১০ হাজার লিটার কেমিক্যাল নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরিবেশ অধিদফতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাড়পত্র দিলেই শুরু হবে নদীতে কেমিক্যাল ছিঁটানোর কাজ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন সংলগ্ন লোকালয়ে মাইকিং করে ভাসমান তেল তুলে নেয়ার আহ্বান জানান হয়। শুক্রবার সকাল থেকে স্বতঃর্স্ফূতভাবে এলাকার মানুষ তেল সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ে। তাদের সংগৃহিত তেল স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে। ভাসমান তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া রোধে ও তেল তোলার (অপসারণ) সুবিধার্থে জোয়ারের সময় খালগুলোতে ফার্নেস অয়েল যাতে বের হতে না পারে সেজন্য ১৪টি খালের মুখে নেট দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে বলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুঃ শুকুর আলী জানান। তাঁর ভাষায়, ‘আপাতত কেমিক্যাল ছিঁটানোর কাজ বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত চাওয়া হয়েছে, তাঁদের মতো পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিআইডব্লিউটিএয়ের চেয়ারম্যান মোঃ শামসুদ্দোহা খন্দকার জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তিন দিন বন সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের সহায়তা নিয়েই তেল সংগ্রহের চেষ্টা করা হবে। পরে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। পদ্মা অয়েলের ঠিকাদার আবদুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক রফিকুল ইসলাম বাবুল জানান, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রতি লিটার ৩০ টাকা দরে স্থানীয়দের কাছ থেকে ৪০০০ লিটার তেল কেনা হয়েছে। ঘটনাস্থল সংলগ্ন কাটাখালি, জয়মনি, জয়মনির ঘোল ও বাদমতলা এলাকায় তেল কেনার জন্য ৪টি বুথ খোলা হয়েছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের চাঁদপাই ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, ঘোষণা অনুযায়ী, স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে শুক্রবার সকাল থেকে তেল সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেন জানান, শ্যালা নদীর জয়মনি থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন খালে তেল সংগ্রহের কাজ করছে স্থানীয়রা। সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল মুক্ত করতে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগের প্রশংসা করেন তেল-গ্যাস-বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য কল্লোল মুস্তফা। তবে তিনি সরকারী উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন। এদিকে, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারর্বার মাস্টার কে এম আকতারুজ্জামান জানান, ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারে ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল। কা-ারিতে মাত্র ১০ হাজার লিটার তেলের তেজস্ক্রিয়তা কমানোর মতো রাসায়নিক রয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, সুন্দরবনের মধ্যে তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে তাঁরা মত দেন। বিশেষ করে জোয়ারে তেলযুক্ত পানি বনে প্রবেশ করায় গাছের গোড়ায় ও শ্বাসমূলে তেলের আবরণ লেগে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে।
×