ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুয়েটের কেন এই অনীহা?

যেখানে তৈরি হয়েছিল জাতীয় পতাকা সেখানেই ওড়ে না

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

যেখানে তৈরি হয়েছিল জাতীয় পতাকা সেখানেই ওড়ে না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মানচিত্র শোভিত প্রথম পতাকার নকশা করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র শিব নারায়ণ দাশ। লাল বৃত্তের মাঝে হলুদ রঙের মানচিত্র শোভিত দেশের এ পতাকার সঙ্গে তাই বুয়েটের সম্পর্ক নিবিড়। অথচ সেই বুয়েটেই বছরের দু-একটি বিশেষ দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয় না! জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রেদ্ধা জানানোর বিষয়ে সাংবিধানিক বিধিবিধান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর আদেশ থাকার পরও দেশের অন্যতম এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কোন ব্যবস্থাই রাখেনি। এদিকে উপাচার্যের কাছে এবারের বিজয় দিবস থেকেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও ২৫ মার্চের মধ্যেই ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি তুলেছে বুয়েট বঙ্গবন্ধু পরিষদ। আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন দাবি উঠলেও প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপটে ওড়েনি জাতীয় পতাকা। হয়নি মুক্তিযুদ্ধের কোন ভাস্কর্য। দেশের অনেক মাদ্রাসা ও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। মাঝে মাঝেই গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় এসব তথ্য। কিন্তু বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানেই জাতীয় পতাকার প্রতি চরম অবহেলার চিত্রটি রয়ে গেছে আড়ালেই। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, গাওয়া হয় না জাতীয় সঙ্গীত- এমন তথ্য আসার পরই গেল সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না; সেসব প্রতিষ্ঠানে তালা লাগিয়ে দিন। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গীবাদ দমন: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ আহ্বান জানিয়ে আরও বলেছেন, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না সেগুলোতে ছোট্ট করে হলেও তালা লাগিয়ে দিন; আর সহ্য না হলে পুড়িয়ে দেন। দায়দায়িত্ব আমার। জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারেও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কর্ম দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে বাধ্য। মাদ্রাসা নিয়ে নানা কথা সব সময় এলেও এবার বুয়েটের প্রগতিশীল শক্তির প্রশ্ন, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠান কেন জাতীয় পতাকাকে অশ্রদ্ধা করছে কিংবা সেখানকার কর্তৃপক্ষের কেন যুগের পর যুগ এ অবহেলা জাতীয় পতাকায়? প্রগতিশীল শিক্ষকরা বলছেন, এখানে পতাকা উত্তোলনের জন্য সেই অর্থে জোড়ালো কেন দাবি কখনও ওঠেনি। আবার দাবি উঠলেও তা বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নেতা ও কর্তা ব্যক্তিদের তা ভাল লাগেনি। প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করতে পারলেও প্রগতি বিরোধীরা পতাকার বিষয়টি আগাতে দেয়নি। সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরাও ভয়ে এ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি হননি। তবে এবার শক্ত অবস্থান নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রগতিশীল শিক্ষক-কর্মকর্তারা উপাচার্যের কাছে এবারের বিজয় দিবস থেকেই জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দাবি জানিয়েছে। বুয়েট বঙ্গবন্ধু পরিষদ লিখিতভাবে এ বিষয়ে আবেদন জানিয়েছে। একই সঙ্গে ২৫ মার্চের মধ্যেই ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের দাবিও তুলেছে বুয়েট বঙ্গবন্ধু পরিষদ। পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও প্রততিশীল শিক্ষকরা বলেছেন, ভাবতেই অবাক লাগে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকার এ অবস্থা। শিক্ষকরা বলছেন, আমাদের মানচিত্র শোভিত প্রথম পতাকাটির ডিজাইনার ছিলেন শিব নারায়ণ দাস। আজও মানচিত্রসমৃদ্ধ পতাকাটির দেখা মেলে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যে, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বাংলাদেশ ক্রীকেট দলের খেলার সময় দর্শকদের হাতে হাতে, এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও। একাত্তরের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের এ পতাকা উত্তোলন করেন ধানম-ির ৩২নম্বর বাসায়। শিব নারায়ণ দাসের পতাকাটি আমাদের পরিচিত কিন্তু শিব নারায়ণ দাসের নামই আজ বুয়েটের কজন শিক্ষার্থী জানতে পারছে? বুয়েটের দু’একটি জাতীয় দিবস ছাড়া জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না বলে হতাশা প্রকাশ করলেন সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হাবিবুর রহমান। বলছিলেন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করা দুঃখজনক, উদ্বেগজনক। আশা করি, প্রশাসন এ উদ্যোগ নেবে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রগতিশীল এ শিক্ষক বলেন, এ কথা অস্বীকার করব না, আমি দায়িত্বে থাকার সময়ও সেভাবে এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুল হক বলছিলেন, হয়নি সেটা সত্য। তবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলনের বিধান থাকলে অবশ্য শীঘ্রই তা হবে। তবে কেবল জাতীয় পতাকা নয়, এখানে তো সরকারী আদেশ অনুসারে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবিও রাখা হয় না। বিধান অনুসারে তো ডিন, ইউনিট প্রধানদের কক্ষেও ছবি থাকার কথা। কিন্তু উপাচার্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের প্রধান ছাড়া তা হয়নি। আমি নিজে আমার কক্ষে জাতির পিতার ছবি রাখি। কিন্তু এটােেতা বিধান। তা মানা হচ্ছে কই? ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলছিলেন, হ্যাঁ, বিশেষ দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না এখানে। আসলে পতাকা তোলাটাই তো বড় কথা নয়, সম্মান জানানোই বড় কথা। তবে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি যাতে পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখনে একটি চত্বরও থাকবে। পতাকা উত্তোলন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করলেন খোদ উপাচার্য অধ্যাপক খালেদা ইকরামও। তিনি বলছিলেন, দোয়া করবেন ১৬ ডিসেম্বর থেকেই আমরা নিয়মিত পতাকা উত্তোলন করব।
×