ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানবন্দর উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে জাইকা-ডানিডা

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বিমানবন্দর উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে জাইকা-ডানিডা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে হাতে নেয়া হচ্ছে একটি প্রকল্প। দেশের সব বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। পাশাপাশি অবকাঠমো সুবিধা বাড়ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ফলে সুপরিসর উড়োজাহাজের ওঠানামা ও চলাচল নিশ্চিতকরণ, বিদ্যমান ট্যাক্সিওয়ে ডি-টাইপ হতে ই-টাইপে উন্নীত করা, বিমানবন্দরের এ্যারোড্রম ক্যাটাগরি ওয়ান থেকে ক্যাটাগরি টু তে উন্নীতকরণ এবং সাব-সারফেস ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হবে। এতে সহায়তা দিচ্ছে ডেনমার্ক। প্রকল্পটি সফলভাবে শেষ করতে সহায়তা বাড়াচ্ছে দেশটি। পাশাপাশি রাডারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আপ-গ্রেডেশন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আরাস্তু খান জানান, প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের ফলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান অবতরণ ও উড্ডয়নের সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে এবং সুপরিসর বিমান ওঠানামা করতে পারবে। অন্যদিকে দেশের সব বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। সূত্র জানায়, গত ৫ বছরে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে এক হাজার ২৪২ কোটি সোনা ধরা পড়েছে; যেগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত আছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিমানবন্দরে বর্তমানে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। বিমানবন্দর দিয়ে শুধু সোনা চোরাচালান প্রতিরোধই নয়, আকাশপথে নিরাপদ ও নির্বিঘেœ বিমান চলাচলে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে, যশোর ও সৈয়দপুর অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে ২৫ বছরের পুরনো রাডার পরিবর্তন করে নতুন করে প্রতিস্থাপন করা। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এয়ারক্র্যাফটের দুর্ঘটনা রোধে উদ্ধারকাজ ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা। এসব কর্মকা- বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২৯৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১৮৯ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। জাইকার সঙ্গে এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিও সই হয়েছে। বাকি ১০৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। প্রকল্পটি আগামী ২০১৭ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচক সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর বাংলাদেশের ‘গেট ওয়ে’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই বিমানবন্দরে কোন অটোমেটিক এক্সসেস কন্ট্রোল সিস্টেম ও সার্ভেইল্যান্স নেই। এ কারণে এই বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। নতুন যে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে এর মাধ্যমে পুরো শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তা পদ্ধতি স্থাপন করা হবে। সেখানে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান পুরনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এখন তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ছয়টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বর্তমানে এই বিমান বন্দরে কোনো প্রাইমারী সার্ভেইল্যান্স রাডার (পিএসআর) এবং সেকেন্ডারি সার্ভেইল্যান্স রাডার নেই। শাহজালাল বিমানবন্দরে থাকলেও সেটি ৩০ বছরের পুরনো। পুরনো হয়ে যাওয়ায় এগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না। এ ছাড়া যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যে সিভিওআর রয়েছে সেগুলো ২৫ বছরের পুরনো। নতুন প্রকল্পের আওতায় পুরনো রাডার পরিবর্তন করে নতুন করে সংযোজন করা হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্পের আওতায় কমিউনিকেশন ও নেভিগেশন সার্ভেইল্যান্স (সিএনএস) ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। সিএনএস হলো উড়োজাহাজ পরিচালনা ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান উপকরণগুলোর বেশিরভাগ পুরনো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতে নিরাপত্তা ও সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০০৮ সালের ৬ নবেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও ডানিডার সঙ্গে ৩১১ মিলিয়ন ক্রোনার এর কান্ট্রি টু কান্ট্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে চলতি বছরের ৫ মার্চ প্রকল্পের অতিরিক্ত কাজের অর্থায়নের জন্য ২৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার বিষয়ে সংশোধিত ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়ে শক্তিশালীকরণ, আধুনিক কমিউনিকেশন, নেভিগেশনাল ব্যবস্থা এবং প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি পুরান রাডার প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। বিমান বন্দরের ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্ট শক্তিশালী করার জন্য ১৯৯৫-৯৬ সালে আট ইঞ্চি পুরু এ্যাজপাল্ট কংক্রিটের আস্তরণ দেয়া হয়েছিল। এর পর আর কোন সংস্কার করা হয়নি। ওই পেভমেন্টের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। ফলে ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্টে ফাটল দেখা দিচ্ছে। নিরাপদ বিমান চলাচলের জন্য উক্ত পেভমেন্টের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি আস্তরণের মাধ্যমে ট্যাক্সিওয়ে শক্তিশালী করা এবং নিরাপদ বিমান চলাচলের সুবিধার্তে এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ডেনিশ মিক্সড ক্রেডিট অর্থায়নে মূল প্রকল্পটি ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই একনেকে ৪১৪ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন লাভ করে। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। মূল প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ডেনিশ মিক্সড ক্রেডিটের পরিমাণ ছিল ৩২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বাকি ৮৫ কোটি কোটি ২৯ লাখ টাকা সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ছিল। মূর প্রকল্পের আওতায় ট্যাক্সিওয়ের পেভমেন্টের ডিজাইন ১৯৯৫ সালের ৭ জুলাইয়ে ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিসট্রেশন এ্যাডভাইজরি সার্কুলার অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়। বাস্তবায়ন পর্যায়ে ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এ সার্কুলারের ডিজাইন পরিবর্তনের ফলে কাজের পরিধি বৃদ্ধি, অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে যথোপযুক্ত ঠিকাদার নিয়োগের লক্ষ্যে দুবার দরপত্র আহ্বান ও প্রক্রিয়াকরণ, প্রকল্পের অতিরিক্ত অর্থায়নের বিষয়ে অনিশ্চয়তা, ডেনিশ দূতাবাস এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনাসহ বিভিন্ন কারণে প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা ইআরডির মাধ্যমে যোগাযোগের ফলে ডেনমার্ক থেকে অতিরিক্ত ৩৫ মিলিয়ন ক্রোনার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। পেভমেন্টসহ সার্বিক কাজের ডিজাইন পরিবর্তন, হাইস্পিড ট্যাক্সিওয়ের এলাইনমেন্ট পরিবর্তন, নির্মাণ সামগ্রীর দর বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডিকেকের পরিমাণ ও মূল্যবৃদ্ধি এবং রাডারসহ বাদ দেয়া যন্ত্রপাতি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ২৯ মে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সুপারি অনুযায়ী সার্বিকভাবে প্রকল্প ব্যয় ৫৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এর মধ্যে ডেনিশ মিক্সড ক্রেডিট ৪৮১ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকাল ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উল্লেখিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৪৯৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৪৩৯ কোটি ৬৫ লাখ এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৭ শতাংশ।
×