ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

মুক্তিযুদ্ধ ও কমরেড অমূল্য লাহিড়ী

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধ ও কমরেড অমূল্য লাহিড়ী

কমরেড অমূল্য লাহিড়ী একটি নাম। পাবনা জেলার বিপ্লবী আন্দোলনে, কৃষক আন্দোলনে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে, পাকিস্তানের নিষ্ঠুর গণবিরোধী, বর্বর শাসকগোষ্ঠীবিরোধী আন্দোলনে, বাঙালীর স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে আজীবন ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামে বিপুল অবদান রেখে যান পাবনা জেলার লাহিড়ীমোহনপুরের কমরেড অমূল্য লাহিড়ী। প্রায় তিন দশক হতে চলল তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রায় নব্বই বছর বয়সে। তাঁর জীবনে ব্যক্তি সুখের কল্পনা কদাপি ছিল নাÑ ছিল না পারিবারিক জৌলুসেরও। যা কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন তার সবই ব্যয়িত হয়েছে দেশ ও দশের জন্য তাঁরই হাত দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন সর্বত্যাগী মানুষ। আমাদের দাদা, কারও বা কাকা। এবং অপরিহার্যভাবে সবার কমরেড। ’৮০-এর দশকে বা ’৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে যখন আমি নিয়মিত ওকালতি করতাম তখন লাহিড়ীমোহনপুর থেকে পাবনা এলেই তিনি বার লাইব্রেরিতে গিয়ে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করতেন, খবরাদি আদান-প্রদান করতেন। অবশ্যই সেগুলো কমিউনিস্ট পার্টি সংক্রান্ত খবরাখবর। ওই সময়ে তাঁকে এক পেয়ালা চা আনিয়ে দিয়ে একটি ছোট রুমে তাঁকে নিয়ে নিরিবিলি কাগজ-কলম হাতে বসেছি তাঁর স্মৃতিকথা নোট করার জন্য। হয়ত আধা ঘণ্টা ধরে নোট করে তাঁকে থামতে বলতাম, অপেক্ষমাণ লোকজনদের সঙ্গে অন্য রুমে বসে কথাবার্তা বলে ফিরে এসে কিছুক্ষণ আগে যা যা বলেছেন সেগুলোর পুনরোক্তি করতে বলতাম তাঁর দেয়া তথ্যগুলো যাচাই করার লক্ষ্যে। বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করতাম, দ্বিতীয় দফায় তিনি যা বলছেন তা প্রথমবারের সঙ্গে শুধু অসঙ্গতিপূর্ণই নয়Ñ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধীও। অমূল্য লাহিড়ীর বয়স যখন বারো-তেরো, তখন অমূল্য দা বিপ্লবী দল অনুশীলন পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হন। অনুশীলন পার্টির সঙ্গে বেশ কিছুকাল তিনি সম্পৃক্ত থাকেন এবং একপর্যায়ে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে কারাগারে এবং দ্বীপান্তরে থাকাকালে তাঁর যোগাযোগ হয় বহু বিপ্লবীর সঙ্গে। ওখানে তখন সন্ত্রাসী বিপ্লবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ইংরেজরা বহু মার্কসবাদী বই বন্দীদের মধ্যে সরবরাহ করেছিল। বিপ্লবী বন্দীরা সেগুলো গভীরভাবে পড়াশোনা আলাপ-আলোচনা করেন এবং অনেকেই তখন সন্ত্রাসবাদী পথ পরিত্যাগ করে মার্কসীয় তত্ত্বে দীক্ষিত হন। অমূল্য দাও তাঁদের মধ্যে একজন। বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তাঁর সাক্ষাত ঘটে কলকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে। তিনি তাঁকে শ্রমিক আন্দোলানে যোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবন তো শহুরে জীবন নয়। কলকাতা থেকে চলে আসেন তিনি লাহিড়ীমোহনপুরে। যোগ দেন কৃষক আন্দোলনে। একপর্যায়ে সিপিআই নিয়ন্ত্রিত সারা ভারত কৃষক সভার বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির কার্যকরী সংসদের একজন সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনেরও তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কৃষক সমিতির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। বাল্যকালেই তিনি সমবায় আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হন এবং পৈত্রিক সম্পত্তির একটি বড় অংশ সমবায় সমিতিকে দিয়ে উল্লাপাড়া থানার একটি অঞ্চলজুড়ে কৃষি সমবায় গড়ে তুলেছিলেন। তার সুফল কৃষক সমাজ পেয়েছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি ওই এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সম্ভবত পার্টির নির্দেশে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং একপর্যায়ে তিনি কংগ্রেসের পাবনা জেলা কমিটির (হালের পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা মিলে) সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। অমূল্য দা জেল থেকে ১৯৫৩ তে বেরিয়ে আসার পর একে একে আমিনুল ইসলাম বাদশা, বাবর আলী, প্রসাদ রায় প্রমুখ কারাগারে আটক পাবনা জেলার সকল কমিউনিস্ট বন্দীই ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকের মধ্যে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু সকলকেই নিজ শহরে বা থানা এলাকায় অন্তরীণ থাকতে হয় জেলগেট থেকেই পাওয়া নিষেধাজ্ঞা মানতে নইলে আবারও আটক হওয়ার আশঙ্কা থাকত। কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেআইনী। আন্ডার গ্রাউন্ডে গোপনে তাঁরা পার্টির কাজও পরিচালনা করতেন। কিন্তু পাবনা জেলার অনেক কমরেডই দেশবিভাগ এবং পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের হাত এড়াতে দেশত্যাগ করেন। ফলে উপরোক্ত ক’জন, সেলিনা বানু, সিরাজগঞ্জের আবু বকর সিদ্দিকী এবং কয়েকজন পার্টি সদস্য থাকলেন পাবনা জেলায়। তাঁরা সম্ভবত ১৯৫৩ বা ’৫৪ সালে গোপনে লাহিড়ীমোহনপুরের কাছাকাছি কোথাও রাতের বেলায় সমবেত হয়ে জেলা সম্মেলন করে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন অমূল্য দা। কৃষক সমিতির নেতা হিসেবে কমরেড অমূল্য লাহিড়ী তাঁর নিজ গ্রাম লাহিড়ীমোহনপুরে ’৬০-এর দশকে এক বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লক্ষাধিক কৃষক ছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য কৃষক নেতা ও কর্মী তাতে যোগদান করেন। লাহিড়ীমোহনপুর তো বটেই, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার কোন মানুষই আজ পর্যন্ত অতবড় কৃষক সমাবেশ কদাপি দেখেননি। দুঃখের বিষয়, ওই কৃষক সমাবেশের আগে থেকেই আমি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকায় সম্মেলনটিতে যোগ দিতে বা তা দেখার সৌভাগ্য ঘটেনি। ষাটের দশকের গোড়ার বা পঞ্চাশের দশকের একদম শেষের দিককার কথা। হঠাৎ শুনি অমূল্য দা’কে গ্রেফতার করেছে ভোরে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে। কি ব্যাপার? তাঁর বাড়িতে ভারতীয় কংগ্রেসের পতাকা এবং গোপনে রাখা বোমা পেয়েছে পুলিশ। তাই তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছে যার বিচার হবে বিশেষ সামরিক আইন আদালতে যশোরে। কাজেই জামিনের তো প্রশ্নই ওঠে না। স্পেশাল বা সামরিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারক থাকতেন সামরিক বাহিনীর অফিসাররা আর তাঁরা সবাই ছিলেন অবাঙালী, পশ্চিম পাকিস্তানী। সুতরাং দুশ্চিন্তা আমাদের সবার মনে বাসা বেঁধেছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার শেষে রক্ষা পাওয়া গেল দুটি কারণে। প্রথমত. ওই আদালতে আইনজীবী দেয়া যেত এবং যশোরের ভাল একজন ফৌজদারি আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। (চলবে)
×