ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলেই এই বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলেই এই বিপর্যয়

রশিদ মামুন ॥ বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ) সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়ায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্দের নির্দেশ দিলেও তা মানা হয়নি। বড় ধরনের বিপর্যয় রোধের প্রস্তুতি না থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী পর্যায়ে এ ধরনের সমস্যা হলে তা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে তার প্রস্তুতি সরকারের নেই। পানি থেকে তেল আলাদা করার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থাও বাংলাদেশে নেই। বিআইডব্লিটিএ সূত্র জানায়, ২০১১ সালের নবেম্বরে বিআইডব্লিটিএ সব আইন অগ্রাহ্য করে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়। শুরুতে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি জাহাজ চললেও এখন তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০টিতে। এই রুটে চলতি বছরই চারটি জাহাজ ডুবে যায়। এরমধ্যে এমভি শাহিদূত, এমভি হাজেরা-২, এমভি নয়ন শ্রী-৩ এখনও উদ্ধার করা সম্ভবই হয়নি। এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে নৌ সচিব শফিক আলম মেহেদী এবং বিআইডব্লিটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদোহা খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। মংলায় ও মংলা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌপথে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে আশির দশকে বিশেষ খনন প্রকল্পের মাধ্যমে মংলা-বেতবুনিয়া-ঘষিয়াখালী চ্যানেল (নৌপথ) চালু করা হয়। মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল থেকে বলেশ্বর নদের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মংলা-ঘষিয়াখালী বা সংক্ষেপে এমজি চ্যানেল নামে পরিচিত। এই রুট চালুর ফলে বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (গরান বন) সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় এর জীববৈচিত্র্যও প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথে মারাত্মক নাব্য সংকট দেখা দেয় । এ কারণে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথে ভারি নৌযান চলাচল ব্যবহত হওয়ায় মংলা বন্দরের সঙ্গে পণ্য পরিবহনকারী নৌযানগুলো বিকল্প পথ হিসেবে অবৈধভাবে সুন্দরবনসংলগ্ন নৌপথ ব্যবহার করছে। মংলা বন্দরের অদূরে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল শুরু করায় সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কা তৈরি হয়। তখনই বাংলাদেশ নৌ-সড়ক এবং রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বিআইডব্লিটিএ এবং নৌমন্ত্রীর কাছে পৃথক চিঠিতে সুন্দর বনের ভিতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধর দাবি জানায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন ও বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর ৩০ নং আইন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ সংশোধন)- ২০১০ অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী, সুন্দরবন আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করে। এর শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো ধরনের তৎপরতা চালাবে না। এছাড়া পরবর্তী সময় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ (বিশ্ব ঐতিহ্য) হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী, ইউনেস্কোর এই ঘোষণার পর থেকে সুন্দরবন এখন আর শুধু বাংলাদেশের অনন্য সম্পদ নয়, জাতিসংঘভুক্ত সকল সদস্যরাষ্ট্রের সম্পদ। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র, তাই বিশ্বজনীন ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ অঙ্গীকার মানতে হবে। তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় সুপারিশসহ কারণ জানাতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে। আগামী ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া তেলের দূষণ রোধ করতে যে কা-ারি ১০ জাহাজ সেখানে পৌঁছেছে তাতে মোট দূষণের একভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ১০ হাজার লিটার তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক অয়েল ডিসপারসেন্ট নিয়ে কা-ারি ১০ দূষণ কমাতে ঘটনা স্থলে পৌঁছেছে। কা-ারি-১০ থেকে রাসায়নিক ছিটিয়ে দেয়া হবে পানিতে ভাসমান তেলের ওপর। এতে তেলের দূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে পুরো দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। মংলা বন্দরের একজন বোর্ড সদস্য জানান, কা-ারি-১০ জাহাজটিতে যে পরিমাণ রাসায়নিক রয়েছে, তা ব্যবহার করে ৫০০-৬০০ মেট্রিক টন তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যা পানিতে মিশে যাওয়া তেলের একভাগেরও কম। পরিবশে ও বন মন্ত্রণালয় থেকে কারণ অনুসন্ধান ও পরবর্তী কারণীয় জানাতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ নূরুল করিমকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিকে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির উত্তরণে সুপারিশ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য হচ্ছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দীলিপ কুমার দত্ত, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. সুলতান আহমদ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (বাণিজ্যিক) ড. মোঃ রেজাউল হক, বিআইডব্লিউটিএ’র একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক (বিপণন) মীর রেজা আলী, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসনের একজন প্রতিনিধি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিশাখার উপসচিব সৈয়দ মেহ্দী হাসানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। ঘটনার পর বন বিভাগের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সদস্যারা সুন্দরবনে অবস্থান করছেন। যেখানে তেল ছড়িয়ে পড়েছে সেই এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। এ ছাড়া সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। বনবিভাগ সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে এই নৌপথটি বন্ধের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। ফার্নেস তেল সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। নৌমন্ত্রণালয়ের উচিত জাহাজটি দ্রুত উদ্ধার করা। জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এ থেকে বের হয়ে আসতে আজই ঐ পথে নৌযান চলাচল বন্ধ করা উচিত। মংলা বন্দরের সঙ্গে সংযোগ বা অন্য স্থানের সঙ্গে যোগাযোগের অন্য পথ আছে। খনন করলেই সেই পথ ব্যবহার করা সম্ভব। সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে সরকারকে এখনই সেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
×