ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছিটমহল মুক্ত হচ্ছে ॥ সব আয়োজন চূড়ান্ত ॥ অবরোধের ৬৭ বছর

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

ছিটমহল মুক্ত হচ্ছে ॥ সব আয়োজন চূড়ান্ত ॥ অবরোধের ৬৭ বছর

তৌহিদুর রহমান ॥ বহুল প্রতীক্ষিত ছিটমহল সমস্যার সমাধান আসন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহলবাসীর ৬৭ বছরের দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হচ্ছে। ছিটমহলে বসবাসকারী নাগরিকরা তাদের অবরুদ্ধ জীবন থেকে পাচ্ছেন মুক্তি। তাদের পরিচয় সঙ্কটও এখন ঘুচতে চলেছে। দুই দেশের ছিটমহল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভারতের লোকসভার চলতি শীত অধিবেশনে যে কোন দিন সীমান্ত চুক্তি পাস হচ্ছে। এই সীমান্ত চুক্তি পাসের জন্য ইতোমধ্যেই সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে ভারত সরকার। সীমান্ত চুক্তির জন্য এখন প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। এদিকে সীমান্ত চুক্তির পরেই তিস্তার চুক্তির জট খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ভারতের লোকসভার শীত অধিবেশন গত ২৪ নবেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। এই অধিবেশন শেষ হবে আগামী ২৩ ডিসেম্বর। মাসব্যাপী এই শীত অধিবেশনেই পাস হচ্ছে বহুল আলোচিত সীমান্ত চুক্তি। এই চুক্তি লোকসভায় পাসের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে ভারত সরকার। আর এই চুক্তির ফলেই দুই দেশের ছিটমহলবাসীর সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকল ভারতের লোকসভায় অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ভারতের লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘দি কনস্টিটিউশন (ওয়ান হান্ড্রেড এ্যান্ড নাইনটিন্থ এ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৪’ উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বহুল আলোচিত এই বিলটি এবারের অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা বিলগুলোর মধ্যে কার্যতালিকার সাত নম্বরে রয়েছে। এই বিল পাস হলে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর ৬৭ বছরের দুঃখ ও যন্ত্রণার অবসান ঘটবে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা ও দিল্লী সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সেই বছরই চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করে। এরপর ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারত কোনটিতেই অনুস্বাক্ষর করতে পারেনি। বিগত কংগ্রেস আমলে বিরোধী দল বিজেপি ও অসম গণপরিষদ এই বিলের বিরোধিতা করে বলে, ছিটমহল বিনিময় হলে যে পরিমাণ জমি হাতবদল হবে, তাতে ভারত প্রায় সাত হাজার একর বেশি জমি হারাবে। এরপর নানা তৎপরতায় বিজেপি শেষ পর্যন্ত নরম হলেও অসম গণপরিষদের সঙ্গে যোগ দেয় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন। সে হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে ওঠে স্থলসীমান্ত চুক্তি। বিলটি উত্থাপন করতে গিয়ে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ বিরোধিতার মুখে পড়েন। এর আগে সে বছরের মে ও আগস্ট মাসে আরও দুই দফা এই বিলটি উত্থাপনের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। সে সময় তিনি বিরোধীদের তোপের মুখেও পড়েন। সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সফরের সময় সে দেশের সরকারী দল বিজেপি এবং বিরোধী দল কংগ্রেসের একাধিক নেতার সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আলোচনা করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদকে জানান রাজ্যসভায় স্থায়ী কমিটির সাবেক মন্ত্রী শশী থারুরের নেতৃত্বে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে কমিটি বিলটি নিয়ে আলোচনাও করেছে। কমিটিতে আলোচনা চলে তিন মাস ধরে। বাংলাদেশ ও ভারতের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন বিলটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম নবী আজাদও জানান, তার দল বিলটি উপস্থাপন করেছে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা বিলটি বিবেচনা করবে। নেহরু-নুন থেকে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ॥ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর ও কোচবিহারের সীমানা নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় ছিটমহলের উদ্ভব হয়। সমস্যা সমাধানে ১৯৫৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে একটি হয়েছিল। যেটা নেহরু-নুন চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এরপর ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়, অমীমাংসিত সীমান্ত ও অপদখলীয় জমি নিয়ে সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেটা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। তখন এই চুক্তি বাংলাদেশের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলেও ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় দেশটির পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়নি। ফলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন আটকা পড়ে যায়। এরপর কেটে গেছে আরও ৪০ বছর, তবে এই চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আইনগত স্বীকৃতি পাবে ॥ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আইনগতভাবে স্বীকৃতি পাবে। বর্তমানে দু’দেশ সীমান্ত রেখা মেনে নিলেও এর আইনগত স্বীকৃতি নেই। এ ছাড়া আইনের বাস্তবায়নের ফলে দুই দেশে অবস্থিত ছিটমহল বিনিময় এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর করাও সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ভারতের মোট ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের ছিটমহলের সংখ্যা ১১১। আর ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি। চুক্তি বাস্তবায়নের পর ভারতের ১১১টি ছিটমহল যার জমির পরিমাণ ১৭ হাজার একর বাংলাদেশের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে যুক্ত হবে। ৫১টি ছিটমহলে জমির পরিমাণ সাত হাজার একর। এই ছিটমহলগুলোতে প্রায় ৫১ হাজার লোক বাস করে, যারা দুই দেশ থেকে কোন নাগরিক সুবিধা পায় না। ছিটমহলগুলো হস্তান্তরের সময় তাদের ইচ্ছার ভিত্তিতে তাদের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হবে। সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যে বাড়তি ১০ হাজার একর জমি পাবে তার জন্য ঢাকাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। সীমান্ত চুক্তির পক্ষে মমতার প্রকাশ্য অবস্থান ॥ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সীমান্ত চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে এখন তিনি তার অবস্থান বদলেছেন। তিনি এখন প্রকাশ্যেই সীমান্ত চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে তাঁর কোন আপত্তি নেই। ছিটমহলের বাসিন্দাদের দাবি তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেও জানিয়েছে। শীঘ্রই সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। গত ৪ ডিসেম্বর ভারতের কোচবিহারের এক জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। কোচবিহারের যে প্রত্যন্ত এলাকায় মমতার এ জনসভাটি হয়, তার দেড় শ’ মিটারের মধ্যেই বাংলাদেশী ছিটমহল করলার অবস্থান। ছিটমহল ইস্যু নিয়ে মমতার এ অবস্থান পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা এ সমস্যার সমাধান হওয়ার আশা করা হচ্ছে। জানা গেছে, ছিটমহল বিনিময়ে সব আপত্তি তুলে নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েও দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব সঞ্জয় মিত্র। স্থায়ী কমিটিতে অনুমোদন ॥ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সীমান্ত চুক্তির খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি সুগত বসু ও মুমতাজ সংঘমিতা এত দিন বিরোধিতা করে এলেও ওই বৈঠকে চুক্তির পক্ষেই সায় দেন। পহেলা ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে বিনা বাধায় রিপোর্টটি উত্থাপিত হয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেছেন, সীমান্ত চুক্তি বিল সংসদে পাস হওয়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা। রাষ্ট্রপতির ভারত সফরে সীমান্ত চুক্তি গুরুত্ব পাবে ॥ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ চার দিনের এক সফরে ১৮ ডিসেম্বর ভারত যাচ্ছেন। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগও এখন আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এমন এক সময় ভারত সফরে যাচ্ছেন, যখন ভারতের সংসদে চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য আসতে পারে। বাংলাদেশ আশা করে, রাষ্ট্রপতির এই সফরে দুই দেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে আরও গতি পাবে। চুক্তিটি নিয়ে এখনকার পরিস্থিতিকে একটি নতুন মাত্রা বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। দুই চুক্তিতেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত ॥ তিস্তা ও সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই দুই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী দেশটি। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার নয়াদিল্লীতে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের নতুন হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সাক্ষাত করতে গেলে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী জানান, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার বড় দুটি সমস্যা স্থলসীমানা চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি। এ বিষয়ে ভারত সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রণব মুখার্জী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এই দুটি চুক্তির দিকে চেয়ে আছে, আর বিষয়টি ভারতের সরকারেরও জানা। দুই চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিনি ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি, জ্বালানি ও বিদ্যুত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদও প্রকাশ করেছেন। সীমান্তের পরেই তিস্তা চুক্তি ॥ ভারতের লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পরেই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে ভারত সরকার। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সীমান্ত ও তিস্তা দুই চুক্তি বাস্তবায়নে আগ্রহী। তবে কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারত সরকার দুই চুক্তি এক সঙ্গে বাস্তবায়ন না করে পর্যায়ক্রমে এগোনোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রথমে তারা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। এরপর তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে।
×