ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈষম্যহীন সমাজ রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

বৈষম্যহীন সমাজ রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়/ কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে/ নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়...। উঠেছে নতুন সূর্য। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ নয় মাস লড়ে জয়ী হয়েছে বাঙালী। এখন মুক্ত স্বদেশ। বাঙালী নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। এর পরও সত্য, রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। এ অবস্থায় বার বার ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বুধবার একই দাবির কথা উচ্চারিত হলো ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালা থেকে। দশ দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিন আলোচনা সঙ্গীত নৃত্য ও পথনাটকের ভাষায় বলা হলো স্বপ্নের সোনার বাংলার কথা। আলোচনা দিয়ে শুরু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সকলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ধর্ম-বর্ণের নামে কোন বিভক্তির স্থান এখানে হবে না। বাঙালী হিসেবে সকলেই তাঁর অধিকার ভোগ করবেন। মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। আমরা এমন রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনও সেটি পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আমরা দেখি, মন্দির ভাংচুর হচ্ছে। প্রতিমা গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে মূল আদর্শ, সেখানে আঘাত হানা হচ্ছে। মঞ্চের সামনে বসে থাকা আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমরা একদিন এই রাষ্ট্রের কর্ণধার হবে। তখন এই দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলবে। যেন ধর্ম-বর্ণের কোন বৈষম্য না থাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্য না থাকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচার কার্যক্রম কিছুটা থমকে আছে। এটিও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কারণ যার আত্মীয়-পরিজন একাত্তরে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন তাঁদেরও সুবিচার পাওয়ার অধিকার আছে। অধিকারটি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় স্বাগত বক্তব্য। এর পর অনুষ্ঠানের মূল বক্তা অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। ‘রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা’ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন তিনি। শুরু করেন বহু আগে থেকে। বলেন, আমরা দুটো ঔপনিবেশিক শাসনের ক্রিয়াভূমি হয়েছিলাম। একটি ছিল ব্রিটিশদের শাসন। অন্যটি পাকিস্তানীদের। বেশ ক’টি সূত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্রিটিশরা যখন এ দেশে আসে তখন বাংলাদেশ পৃথিবীর ধনী ৪ থেকে ৫ দেশের একটি। এই ধনে প্রলুব্ধ হয়েই এসেছিল লুটেরারা। এরা ১৯০ বছর আমাদের শোষণ করে। আমাদের প্রসিদ্ধ মসলিন ধ্বংস করে। সবকিছু ধ্বংস করে। এ অঞ্চল থেকে ৫০০ কোটি পাউন্ড ওরা নিয়ে যায়। ওই সময় এ অর্থের মূল্য ছিল অনেক। এর ফলে একদিকে আমরা হই কৃষিপণ্যের উৎপাদক দেশ, অন্যদিকে আমাদের লুট হওয়া সম্পদে ওদের শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমানদের বলা হয়েছিল আলাদা সম্প্রদায়। মিথ্যা ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে ফিরে এসেছিল শোষণ। পাকিস্তানীদের ২৩ বছরের দুঃশাসনের কিছু দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, এ পর্যায়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসাধারণ এক যুদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশে যে রাষ্ট্রগুলো ’৪৭ এবং তার পর স্বাধীনতা পেয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই আলোচনার মাধ্যমে হয়েছে। হ্যাঁ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দিতে হয়েছে। ছোট ছোট যুদ্ধ হয়েছে। তবে স্বাধীনতা এসেছে আলোচনার টেবিলে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আলজিরিয়া, ভিয়েতনামেও এত প্রাণ বলি দিতে হয়নি। বর্তমানে এসে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানেরও মূল কথাÑমানুষের অধিকার। তবে এ অধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রে কল্যাণ চাইলে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। সব মিলিয়ে বক্তৃতাসমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন অনুপম সেন। তবে ইতিহাসের এই বাঁক ওই বাঁক লম্বা সময় নিয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি। খুব একটা ধারাবাহিক আলোচনা ছিল না। বরং এ বক্তৃতা যথেষ্ট জটিল টেবিল আলোচনায় রূপ নিয়েছিল। মঞ্চের সামনে বসে থাকা শিশু-কিশোরদের অনেকেই নির্ধারিত বিষয়ের সঙ্গে এ বক্তৃতা মিলিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য পরের পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সকলেই বেশ উপভোগ করেন। এক সঙ্গীত দিয়ে শুরু। পরিবেশন করেন সেমন্তী। এর পর দলীয় নৃত্য। ধ্রুপদ কলাকেন্দ্রের শিল্পীরা নাচের মুদ্রায় শ্রদ্ধা জানায় একাত্তরের শহীদদের। ‘অঞ্জলি লহো মোর’ গানের সঙ্গে চমৎকার নাচেন ৪ শিল্পী। পরের গানে ৩ জন। তাঁদের পরিবেশনায়ও মুক্তিযুদ্ধ ভাষা পায়। দলীয় আবৃত্তির মাধ্যমে একাত্তরকে উপস্থাপন করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সঙ্গীত সংগঠন আনন্দ। অনুষ্ঠানে পথনাটক পরিবেশন করে ‘নাট্যদল’। সাগর সর্দার নির্দেশিত নাটকের শিরোনাম ‘শামুক কাল।’ অনুষ্ঠানের বিশেষ একটি পর্বে অংশ নেয় মানিকনগর মডেল হাই স্কুল ও তেজগাঁও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধ ও আগামীর স্বপ্নের কথা বলে তাঁরা। আয়োজক সূত্র জানায়, একই রকম আয়োজন থাকবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় দিন ১২ ডিসেম্বর একই মঞ্চে সংগ্রহকারী ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য পাঠ করে শোনাবে। ১৪ ডিসেম্বর মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এদিন শহীদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের অনুভূতি জানাবেন সংশ্লিষ্টরা। ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ আয়োজন থাকবে শিশু-কিশোরদের জন্য। বিজয় দিবসের বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে হাজির হবে ছোটদের বিভিন্ন সংগঠন। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে আসবে কিছু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।
×