ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা বাংলাদেশের

লিমা সম্মেলনে হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অর্জনের টার্গেট

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

লিমা সম্মেলনে হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অর্জনের টার্গেট

কাওসার রহমান, লিমা (পেরু) থেকে ॥ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন কার্যক্রমে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের বোর্ড সভায় সবুজ জলবায়ু তহবিলের ৫০ শতাংশ অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য অভিযোজন কার্যক্রমে এবং ৫০ শতাংশ অর্থ কার্বন নির্গমন হ্রাস কার্যক্রমে খরচ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন এই সিদ্ধান্ত ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হতে যাওয়া প্যারিস প্রোটোকলে অন্তর্ভুক্তির জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে অস্ট্রেলিয়া। তাদের বক্তব্য এই সিদ্ধান্ত আইনী বাধ্যবাধকতায় চলে আসলে স্বল্পোন্নত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অর্থ প্রাপ্তিতে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে। বড় উন্নয়নশীল দেশগুলোই এই সুবিধা নিয়ে যাবে। ফলে বঞ্চিত হবে ছোট দেশগুলো। এক্ষেত্রে অবশ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর বক্তব্য হচ্ছে, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড বা সবুজ জলবায়ু তহবিলের যে ৫০ শতাংশ অর্থ অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ অর্থ পাবে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট দেশগুলোর কোন স্বার্থহানি ঘটবে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এ ব্যাপারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অবস্থান হচ্ছে ৫০ শতাংশ অর্থ অভিযোজনে এবং ৫০ শতাংশ অর্থ প্রশমনে বরাদ্দ দিতে হবে। যদিও উন্নত দেশগুলো অভিযোজনে গুরুত্ব দিতে চায় না। তারা গুরুত্ব দেয় প্রশমনে। এ পর্যন্ত এবারের সম্মেলনের বড় অর্জন হচ্ছে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে অর্থ বরাদ্দ। দীর্ঘদিন শূন্য থাকার পর সবুজ জলবায়ু তহবিল ক্রমেই অর্থে ভরে উঠছে। এবারের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার ক্ষতি মোকাবেলায় এক হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অর্জন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ তহবিলে ৯৫০ কোটি ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ৩০০ কোটি ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্যারিস প্রোটোকলের আইনী কাঠামোর খসড়া তৈরির এই বিতর্কের মধ্য দিয়েই মঙ্গলবার শুরু হওয়ার কথা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। পেরুর রাজধানী লিমায় ‘হাই লেভেল সেগমেন্ট’ খ্যাত উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকের উদ্বোধন করার কথা পেরুর প্রসিডেন্ট ওলান্তা হুমালা তাসোর। এ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিচ্ছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। গত এক সপ্তাহ ধরে কারিগরি পর্যায়ের (কর্মকর্তা পর্যায়ে) আলোচনা শেষে শুরু হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বোচ্চ ফোরামের আলোচনা। কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। তাই আশা করা হচ্ছে, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে লিমা জলবায়ু সম্মেলন গতি পাবে। তবে বাংলাদেশের মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সম্মেলন নিয়ে খুব আশাবাদী নন। সোমবার বিকেলে সম্মেলন কেন্দ্রে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রথম সমন্বয় সভায় তিনি বলেন, এ সম্মেলন নিয়ে বাংলাদেশের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য অংশগ্রহণ করছি। এ সম্মেলন থেকে আমরা খুব বেশি লাভবান হব না। অবশ্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কার্বন কমানোর ঘোষণা দেয়ায় পেরু সম্মেলনে কিছু একটা হবে বলে তিনি মনে করেন। সেক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তির ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হওয়া নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, নতুন চুক্তি কার্যকর হতে ২০৫০ সাল লেগে যেতে পারে। তিনি বলেন, অভিযোজন কার্যক্রমে অর্থ না বাড়লে বাংলাদেশের জন্য তা সুখবর হবে না। আর এক্ষেত্রে অর্থ না বাড়লে সম্মেলনে আসা-যাওয়ার যাতায়াত খরচ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। পেরুতে চলমান জলবায়ু আলোচনা ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে বলে জানান বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সমন্বয়কারী পরিবেশ ও বন সচিব নজিবুর রহমান। তিনি বলেন, চীন- যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ ছিল। সেই বিরোধ মিটে গেছে। তারা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে কার্বন কমানোর বিষয়ে। তাদের সেই চুক্তি সম্মেলনে ইতিবাচক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। ফলে আমরা আশা করছি, ফ্রান্সে আমরা আরও ভাল কিছু পাব। তিনি বলেন, জলবায়ু দরকষাকষিতে বিভিন্ন গ্রুপের ইতিবাচক ব্যক্তিগণ এবার লিমায় এসে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাঁরা প্যারিসে চুক্তি চাচ্ছেন। সে কারণে পেরুতে নতুন আইনী কাঠামো অনুমোদনের বিষয়টি সঠিক পথেই এগুচ্ছে। ফলে প্যারিসে আইনী কাঠামোর সম্ভাবনা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সোমবার সকালে প্যারিস প্রোটোকলের আইনী কাঠামোর খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়া নিয়ে দিনভর আলোচনা হয় গ্রুপে গ্রুপে। সবাই নতুন এই খসড়া নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। রাতে স্বল্পোন্নত দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই খসড়ার বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ঠিক করেন। এই খসড়া চূড়ান্ত করে তা অনুমোদনের ওপরই নির্ভর করছে প্যারিস জলবাযু সম্মেলনের ভবিষ্যত। পেরু জলবায়ু সম্মেলনে এই আইনী কাঠামো অনুমোদন না হলে প্যারিসে সকল দেশকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় আইনী চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে সম্মেলনের পর্যবেক্ষক স্বল্পোন্নত দেশের মুখপাত্র ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলায় আইনী কাঠামো খসড়া দলির তৈরির কাজ চলছে। এই খসড়া লিমার জলবায়ু সম্মেলনে অনুমোদন হতে হবে। তার জন্য সকল দেশের মন্ত্রীদের পরিষ্কার সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। তাহলে পেরু জলবায়ু সম্মেলন সফল হবে। তিনি জানান, প্যারিস প্রোটোকলের আরও একটি বিশেষ দিক হলো- প্রত্যেক দেশ কি পরিমাণ কার্বন কত সময়ের মধ্যে হ্রাস করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। এজন্য কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে সে পরিকল্পনাও উল্লেখ করতে হবে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এই পরিকল্পনা দলিল জমা দেয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ২০০৫ সালের তুলনায় ২৬-২৮ শতাংশ কার্বন কমাবে। আর চীন ঘোষণা দিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা ২০ শতাংশ কার্বন হ্রাস করবে। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ কার্বন কমানোর ঘোষণা দেয়।
×