ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনব্যাপী বিয়ে উৎসব

বিয়েকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উপস্থাপনা, হবু বর কনেদের ভিড়

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

বিয়েকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উপস্থাপনা, হবু বর কনেদের ভিড়

মোরসালিন মিজান ॥ দিল্লিকা লাড্ডু বলে কথা। খেয়ে দারুণ সুখ। বিপর্যয় ঘটারও আশঙ্কা থাকে। যার যা ভাগ্য। মেনে নিয়েই বিয়ে। বিয়ের পিঁড়িতে বসা। সারা বছরই সাতপাঁকে বাঁধা পড়ছে জীবন। বিয়েবাদ্যি লেগেই থাকে। তবে এখন সময়টা বিয়ের জন্য বিশেষ অনুকূল। বৃষ্টির ঝামেলা না থাকায় অনেকেই শীতের কালটিকে বেছে নেন। নবেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে বিয়ের মৌসুম। মঙ্গলবার মৌসুমটির কথা বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিল বিয়ে উৎসব। হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত দিনব্যাপী উৎসবে বিয়ের প্রয়োজনীয় কেনাকাটাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সেইসঙ্গে ছিল বাঙালীর বিয়েকেন্দ্রিক সংস্কৃতির চমৎকার উপস্থাপনা। সব মিলিয়ে দারুণ আনন্দঘন সময় কাটিয়েছেন হবু বর কনেরা। পরিবারের ‘মুরব্বিরা’ও বাদ যাননি। সন্তানের বিয়ের খরচের আদ্যোপান্ত জেনে তবেই ঘরে ফিরেছেন! বিয়ে উৎসব নামে এ ধরনের আয়োজন রাজধানীতে প্রথম। বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে স্টল সাজিয়েছিল। প্রথমেই চোখে পড়ে বিয়ের শাড়ি। দেশীয় এসব শাড়িতে ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। কাতান বেনারসি জামদানি শাড়ি বিয়েতে এখনও প্রচুর ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রতি পরতে যতেœর ছাপ। কী যেন মায়া লেগে ছিল। একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল, শুধু বেনারসি। উজ্জ্বল রং। পুরোটাজুড়ে কারুকাজ। স্টলের কর্মীরা শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন সাফায়েত আলী তরফদার জানালেন, বিয়ের মূল শাড়িটা একটু মোটা ধরনের। পাঁচ তাকের শাড়ি। প্রধানত লাল ও মেরুন রঙের হয়ে থাকে। তাতে নয় রঙের কাজ করা। এসব রংয়ে সংসার জীবনের স্বপ্ন সুখ হাসি কান্না ইত্যাদির প্রতীকী উপস্থাপনা। কারিগরদের দেয়া শাড়ির নাম সাটেন ও ব্রোকেট। শাড়িগুলোতে জাদরজির কাজ করা। জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কনের জন্য সবুজ ও নীল বেনারসি বেশি ব্যবহার করেন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বেছে নেন সাদা রঙ। বৌ-ভাতের সময় কনে যে শাড়ি পরেন সেটি বিয়ের দ্বিতীয় শাড়ি হিসেবে পরিচিত। বেনারসির বিক্রেতা জানালেন, কনের শাড়ির দামের শুরুটা ১০ হাজার থেকে। ১ লাখ ৩০ হাজারে গিয়ে থামে। তার আগে অবশ্য গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা। এ ক্ষেত্রে একটি দুটি শাড়িতে হয় না। অনেক দরকার হয়। কারণ, গায়ে হলুদের সময় আত্মীয় ও আমন্ত্রিতরা সবাই একই শাড়ি পরেন। হলুদের শাড়ি এক সময় হলুদ রঙের হতো। তবে বিভিন্ন স্টল ঘুরে বোঝা গেল, এখানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন শাড়ির পুরোটা হলুদ হয় না। অন্য রঙের মিশেলে নতুন নতুন ডিজাইন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব শাড়ি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য আসলে কোথায়? জানতে চাইলে কারিগর বলেন, বুনন পদ্ধতিতে পার্থক্য। এছাড়াও আছে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য যা চট করে কেউ ধরে ফেলতে পারে না। দেশীয় শাড়িগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইল শাড়িরও খুব কদর। সেসব শাড়ি নিয়ে এসেছিল টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। বরের আলোচনায় প্রথমেই আসে শেরওয়ানি। শেরওয়ানি দিয়ে স্টল সাজিয়েছিল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড লুবনান। প্রায় সবক’টি শেরওয়ানি চোখ ধাঁধাঁনো। মোটা কাপড়ে পুঁথিপাথর ইত্যাদি বসানো। বড় বড় বোতামগুলো চক চক করছিল। ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার নাদিম মাহমুদ জানান, তাঁদের শেরওয়ানির দাম শুরু ১২ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা থেকে। আছে ৩০ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা পর্যন্ত। যারা বিয়েতে শেরওয়ানি পরতে চান না তাঁদের জন্য আছে বিশেষ পাঞ্জাবি। দোকানির ভাষায়Ñ গর্জিয়াস পাঞ্জাবি। দাম ১০ হাজার ৫শ’ ৫০ থেকে ২৫ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা। আক্দ বা গায়ে হলুদের সময় ওয়েস্টকোট পরারও রীতি চালু আছে। বিয়ের বেলায় আবহমান কাল থেকেই গহনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ধনাঢ্য পরিবারের বিয়েতে কনের গা মোটামুটি স্বর্ণে মুড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে সে জায়গার অনেকটা নিয়ে নিয়েছে ডায়মন্ড। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামের একটি স্টলে আংটি নেকলেস ইত্যাদির আকর্ষণীয় ডিজাইন দেখানো হচ্ছিল। ধারণা দেয়া হচ্ছিল দাম সম্পর্কে। ডায়মন্ড গোল্ড ছাড়াও ছিল গোল্ড প্লেটেড গহনা। এরাবিয়ানস নামের একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল এই গহনা স্বর্ণের অবিকল। ডিজাইনে চোখে পড়ার মতো বৈচিত্র্য। সবক’টিতেই স্টোন বসানো। জ্বলজ্বল করছিল। স্টলের দায়িত্বে থাকা তাহসিন হাসান জানালেন, বিয়ের যাবতীয় গহনা এখান তাঁরা সরবরাহ করেন। ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় মিলবে কনে সাজানোর পুরো সেট। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলে মুখ্য হয়ে ওঠে সাজগোজ। বিউটি সেলুনগুলোতে ছুটেন শহুরেরা। এ ক্ষেত্রে আগেভাগেই আসে ‘পারসোনা’র কথা। এই স্টলে ভিড় লেগেছিল। বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের এই প্রশ্ন ওই প্রশ্ন। আরও সুন্দর আরও ভাল সাজ কীভাবে হতে পারে? খরচ কেমন হবে? হাজারটা প্রশ্ন। উত্তর নিয়ে তবেই জায়গা ছাড়ছিলেন তাঁরা। ছোট্ট স্টলের এক কোণে আবার চোখের মেকাপ চলছিল। বিনা খরচে। সুযোগটি দারুণ কাজে লাগিয়েছেন কৌতূহলীরা। পাশেই ‘ফারজানা শাকিলস’। সেখানেও প্রায় একই রকম ভিড়। স্টলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সবক’টি বিউটি সেলুনের এখন চলছে ব্রাইডাল প্যাকেজ। সেই প্যাকেজেরও আছে নানা প্রকার। বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রি ব্রাইডাল। তারপর বিয়ের দিন চূড়ান্ত সাজ। এত যে সাজ, এরপর কনে দেখতে কেমন হয়? সেটি জানার সুযোগ করে দিয়েছিল ‘ক্লিওপেট্রা’ নামের বিউটি সেলুন। তাঁদের স্টলে জলজ্যান্ত কনে। মুখে গাঢ় মেকাপ। মুখের বাড়তি উজ্জ্বলতা বাহুতেও। চুল উপরের দিকে যেন ফু দিয়ে ফুলানো। পেছন দিক থেকে কায়দায় করে বাঁধা। গায়ে ট্র্যাডিশনাল লেহেঙ্গা। গহনার কোনটি বাদ ছিল না। কথা বলে জানা গেল কনের নাম জেনিফার। বিয়ে এখনও হয়নি। বিয়ের সাজে সেজেছেন শুধু! তবে এই সাজ উৎসবে বিয়ের আমেজ ছড়িয়েছিল পুরোদমে। বিয়ের আরেক অনুষঙ্গ ফুল। কুঞ্জ সাজাতে, বর কনেকে বহনকারী গাড়ি এবং বাসরঘর সাজাতে ফুলের কোন বিকল্প নেই। ফুলতলা ও ইকেবানা নামের দুটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল, ল্যাপটপ কম্পিউটারে সব ডিজাইন প্রস্তুত করা। যার যেমন চাই দেখে অর্ডার করলেই হলো। ‘ফুলতলা’র বাবু জানালেন, যত বেশি ফুল খরচ তত বাড়ে। সে ক্ষেত্রে স্টেজের খরচ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ওঠে যায়। বননীর ‘ইকেবানা’ কাজ করে বিদেশী ফুলে। রিপন নামের এক কর্মী জানালেন, বিয়ের স্টেজ করতে তাঁরা ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। জীবনের স্মরণীয় দিনটি ক্যামেরায় ধরে রাখারও ব্যাপার আছে। কিছুদিন আগেও বর কনের আত্মীয় বন্ধুরা কাজটি করতেন। এখনকার আবিষ্কার ‘ব্রাইডাল ফটোগ্রাফি’। অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। ‘ওয়েডিং ডায়েরি’ নামের একটি স্টল থেকে ক্রিয়েটিভ হেড পলা রহমান জানালেন, সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ধরে রাখার জন্য তাঁদের আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার। অনুষ্ঠানের পর সিডিতে সব ছবি সরবরাহ করা হয়। কিছু ছবি বাঁধিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। বিয়ে উৎসব যেহেতু, মিষ্টি বাদ যাবে কেন? বর কনের বাড়িতে মিষ্টি বিনিময়ের ঐতিহ্যও তুলে ধরা হয়েছিল এ আয়োজনে। উৎসবে মিষ্টির একাধিক স্টল ছিল। ‘প্রিমিয়াম সুইট’র স্টলে গিয়ে দেখা গেল হরেক রকমের মিষ্টি। কত যে আকার আকৃতি রং! টাকাও ভালই গুনতে হয়। মিষ্টি দিয়ে সাজানো মাঝারি আকারের একটি ডালার দাম এখানে ৬ হাজার ৯শ’ ৯৫ টাকা। উৎসবের আর যে আকর্ষণ, সেটি ব্যান্ড পার্টি। তপন ব্যান্ড পার্টির সদস্যরা খুব মজা করে বাজাচ্ছিলেন। বিচিত্র দেখতে বাদ্যযন্ত্র। তবে বেজে ওঠতেই পুরো এলাকা উৎসবমুখর। এ উৎসব গোটা দিনভর উপভোগ করেছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ।
×