ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক অসহায় বীর মুক্তিযোদ্ধার আকুতি

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

এক অসহায় বীর মুক্তিযোদ্ধার আকুতি

শেখ আব্দুল আওয়াল গফরগাঁও থেকে ॥ মাইনষ্যার মুহে হুনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের লাগি ঘরবাড়ি তৈয়র কইরা দিব, তালিকাও অইছে, হেই তালিকার মধ্যে আমার নাম নাই, তবে যার জমি আছে, ঘর আছে তাগোর নাম থাকলে আমার নাম নাই ক্যান? কথাগুলো বলছিলেন গফরগাঁওয়ের রসুলপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ৬৯ বছর বয়স্ক জহুর উদ্দিন। এই প্রতিবেদক যুদ্ধের সময়ের ঘটনা জানতে চাইলে বার বার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শেষে রেগে গিয়ে বলেন, লেখলে কি অইব? আমার কথা কে হুনব? লেখবেন তো লেখেন- আমার নাম জহুর উদ্দিন, পিতা- মৃত ইসমাইল উদ্দিন, মায়ের নাম সহর জান-মুক্তি নং- ০১১৫০৯০০৮৩। নিজের লাইগ্যা যুদ্ধ করি নাই, করছি দেশের লাইগ্যা। এহন রিক্সা চালাইয়া ভাত খাই। আধা শতাংশ জমিতে বাঁশের বেড়া আর পলিথিনের কাগজ দিয়া ছুডু একটা ঘর বানছি। ঘর হুতলে বুহ পানি পড়ে। মইরা গেলে কবরে জায়গা নাই। ১ পোলা ১ মাইয়া লইয়া ক্ষিদার জ্বালা বছরে পর বছর ভুগতাছি। ভাতের ফেন খাইছি। যুদ্ধকালীন ১০-১৫ দিন পর পর একবার ভাতের দেহা পাইতাম। যুদ্ধ শেষ। কষ্টের মাত্রা সোওন যায় না। রসুলপুর গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায় কাক ডাকা ভোরে জীবন-জীবিকার তাগিদে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে গেছে জহুর উদ্দিন। ঘণ্টা দুই অপেক্ষার পর দেখা গেল দুজন পেসেঞ্জার নিয়ে এগিয়ে আসতে। তেজহীন সূর্যের উপস্থিতি থাকার পরও মাথা থেকে ঘাম ঝরে পড়ছিল জহুর উদ্দিনের। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর অন্যদিকে মুখ ফেরান জহুর উদ্দিন। এলাকাবাসীর ও এ প্রতিবেদকের অনুরোধে লোমহর্ষক অনেক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। ২৫ বছরের যুবক জহুর বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। রাস্তায় গিয়াস উদ্দিন (স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার) চানু, মোখলেছসহ অনেকেই ভারত অভিমুখে যাত্রা করে। সেখানে কল্যাণ ও তুরা ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয়ার কথা জানান। পরবর্তী সময়ে ৭০ জনের একটি মুক্তিবাহিনীর দলসহ দুর্গাপুর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে তারা। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল দুর্গাপুর বাজারে পাক সেনাদের ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করতে হবে। কথা মতো আক্রমণ শুরু হলে সহযোদ্ধা দুজন শহীদ হলেও পাকসেনাদের অনেকেই মারা যায়। কমান্ডারের নেতৃত্বে চারটি অপারেশন হয়। এর মধ্যে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসহ সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন জহুর উদ্দিন। জহুর আজ খুবই ক্লান্ত। বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে পারেনি তার মাথা। সরজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে সত্যিই জহুর খুব কষ্টে আছে। বেঁচে থাকার জন্য বাপ ছেলে মিলে রিক্সা চালাচ্ছে। বিজয়ের ৪০ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। জহুরের রণাঙ্গনে বহু সাথী দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে নিলেও আজ তাদের কোন খোঁজ নেই। এখন তারা অনেকেই ভাল আছে। স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার জন্য যে কষ্ট করছি তার ভাগ কেউ নেয় না বলে জানান জহুর। ভাতার দিকে চেয়ে দিন পার করি। আর ভাবি দেশ স্বাধীনের আগে যেমন ছিলাম এখন আরও দুঃসময় যাচ্ছে। মাঝখানে অতিবাহিত হলো স্বাধীনতার সুফলের ৪৩টি বছর। আমি জহুর মারা গেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চাই না-চাই আমার সন্তানদের জন্য একমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা। জহুরের দু’চোখ ছলছল করে ওঠে। বলে সহযোদ্ধারা মরে গিয়ে ভালই করেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিদ্ধার্থ শংকর কুন্ড জনকণ্ঠকে বলেন, আমি নতুন এসেছি, এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধার খোঁজখবর নিয়ে সব রকম সহযোগিতার চেষ্টা করব।
×