ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বেগম রোকেয়া দিবস, পায়রাবন্দে দায়সারা কর্মসূচী

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

আজ বেগম রোকেয়া দিবস, পায়রাবন্দে দায়সারা কর্মসূচী

মানিক সরকার মানিক, রংপুর থেকে ॥ মহীয়সী বেগম রোকেয়া ১৯৩১ সালের ৩০ এপ্রিল তার কষ্ট আর আক্ষেপের কথা প্রকাশ করে চাচাতো বোন মোনাকে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘শৈশবে বাবার আদর পাইনি। বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর সেবা করেছি, প্রত্যহ ইউরিন পরীক্ষা করিয়েছি, পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দু’বার মা হয়েছিলুম, তাদেরও প্রাণ ভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বছর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়েছি। সুতরাং নুরী আর আমাকে বেশি কী কাঁদাবে? সেতো বোঝার উপর শাকের আঁটি মাত্র। আমি আমার ব্যর্থ জীবন নিয়ে হেসে খেলে দিন গুনছি’-আজ থেকে ৮৪ বছর আগে মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া যেমন তার কষ্ট আক্ষেপের কথা নীরব-নিঃশব্দে লিখে গেছেন, আজ তিনি বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে বরাবরের মতই রাষ্ট্রের দায়সারা কর্ম দেখে আরও বেশি কষ্ট পেতেন। আজ ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও মহীয়সীর জন্মভূমি রংপুরের পায়রাবন্দে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনদিনব্যাপী নেয়া হয়েছে দায়সারা কিছু কর্মসূচী। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, প্রথম দিন সকাল ৯টায় পায়রাবন্দে রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ১০টায় মিলাদ মাহফিল আর বিকালে মেলা উদ্বোধন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও স্থানীয় আলোচক ও শিল্পীদের নিয়ে একই ধরনের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া মেলায় থাকছে গুড়ের জিলাপি, চুরি ফিতা আর কাঠের তৈরি শিশুদের খেলনা। পায়রাবন্দ তথা রংপুরবাসী রোকেয়া দিবসে প্রতিবারের মতো গতানুগতিক এই কর্মসূচীকে একান্তই লোক দেখানো ও দায়সারা কর্মসূচী উল্লেখ করে বলছেন, ‘বঙ্গের মুসলিম ‘অবরোধ বাসিনী’দের মুক্ত করার জন্য যে নারী আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে ‘জোয়ান অব আর্ক’ ‘হেলেন কিলার’ ‘ফ্লোরেন্স নাইট এ্যাংগেল’ মাদার তেরেসাঁ’র মতো অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাকে নিয়ে এই কর্মসূচী নিছক ঠাট্টা আর তামাশারই শামিল’। পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার তথ্য সংগ্রাহক ও পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, রাষ্ট্র যদি নারীবান্ধব হতো, তবে রোকেয়া দিবসটা উপেক্ষিত হতো না। রাষ্ট্র রোকেয়াকে গ্রহণ করেনি, কিন্তু অস্বীকারও করতে পারছেন না। এই কারণে রাষ্ট্র কিছু না কিছু নামকাওয়াস্তে করছে। তিনি জানান, বিবিসি গোটা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালীর নির্বাচনের জন্য একটি জরিপ চালায়। তাতে মহীয়সী রোকেয়ার অবস্থান রয়েছে ৬ নম্বরে। তার আগের ৫ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও নেতাজী সুভাষ বসু। তিনি জানান, ময়মনসিংহের ত্রিশালে নজরুল জয়ন্তী পালন করা হয় সপ্তাহব্যাপী রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেখানে বিখ্যাত নজরুল গবেষক করুণাময় গোস্বামী, যতীন সরকার, কবি নুরুল হুদাসহ সেই মাপের গুণীজনদের উপস্থিতি ঘটে। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন উৎসব পালন করা হয় ৫ দিনব্যাপী। সেখানে জাপানের ফাকিয়ো ইয়াসু, ভারতের শিব বাউলসহ বিশ্বের সেরা লালন গবেষকদের নিয়ে আসা হয়। শিয়ালদহে বাঙালি সংস্কৃতির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কী ধরনের অনুষ্ঠান হয় তা আমাদের সবার জানা। এছাড়াও ফরিদপুরে পল্লী কবি জসীম উদ্দিন, রাজবাড়িতে মীর মোশাররফ হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে যোগ দিয়ে থাকেন ড. আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলামের মত গুণীজনেরা। সেখানে রোকেয়া দিবসে কোন গবেষক আর কাদের নিয়ে এসে যে ধরনের অনুষ্ঠান করা হয় তা রীতিমত লজ্জাজনক। শুধুমাত্র রোকেয়া দিবসের আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর মেলাই নয়, মহীয়সী বেগম রোকেয়া সকল ক্ষেত্রেই চরমভাবে উপেক্ষিত আর অবহেলিত হয়ে আসছে। দীর্ঘ বছর পর রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সে সময়ই লোকবল নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে সেই স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৪ কোটি টাকার অবকাঠামো, স্থাপনা মূল্যবান আসবাব বিলীন হতে চলেছে। দেশের কোথাও কোন স্মৃতি কেন্দ্র এমন অবজ্ঞা অবহেলায় পড়ে আছে এর নজির নেই। অবজ্ঞা অবহেলায় পড়ে আছে রোকেয়া পরিবারের বিশাল পুকুর, হাওয়াখানাসহ সাড়ে তিন শত বিঘা লাখেরাজ জমি। এসবের মধ্যে ৫৩ একর জমি নির্ধারণ হলেও এবং এসব উদ্ধারে হাইকোর্টের আদেশ থাকলেও রাষ্ট্রের গড়িমসির কারণেই বেহাত হয়ে থাকা এসব জমি উদ্ধারে তৎপরতা নেই। এলাকাবাসীর দাবি এসব জমি উদ্ধার করে সেখানে রোকেয়া এস্ট্রেট গড়ে তোলার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী স্টাফ রিপোর্টার ॥ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন শতাব্দীতে নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠায় সকলকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি এক বাণীতে বলেছেন, বেগম রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার জন্মদিনে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘বেগম রোকেয়া দিবস-২০১৪’ উদযাপিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। এ বছর নারী ও সমাজ উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখার জন্য যারা ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০১৪’ পেলেন আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। মহীয়সী বেগম রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বেগম রোকেয়া দিবস-২০১৪ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচীর সার্বিক সাফল্য কামনা করেন রাষ্ট্রপতি। বেগম রোকেয়ার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনগ্রসর নারীদের এগিয়ে নিতে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে সমাজের সকল স্তরের দায়িত্বশীল মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বেগম রোকেয়া শুধু একটি নাম নয়; তিনি ছিলেন নারী শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান।ঊনবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল সমাজের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেগম রোকেয়া নারী জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেন শিক্ষার আলো। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের মূলে আঘাত হানেন। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের মধ্য দিয়ে পশ্চাৎপদ নারীসমাজকে আলোর পথ দেখান। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রভূত অবদান রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার সমাজের সর্বস্তরের নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে আমরা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ ও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ প্রণয়ন করেছি। নারী শিক্ষা প্রসারে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হয়েছে। নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা, শ্রমবাজারে ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে এবং নারীর প্রতি সামাজিক অপরাধ রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর বলিষ্ঠ অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত বরেন, পদকপ্রাপ্ত গুণীজনেরা বেগম রোকেয়ার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশের অনগ্রসর নারীদের উন্নয়নে নিজেদের আরও সম্পৃক্ত করবেন। বেগম রোকেয়ার কর্মময় জীবন ও তার আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এদেশের নারীসমাজ আরও সামনে এগিয়ে যাবেন। বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচী এবং বেগম রোকেয়া পদক-২০১৪ প্রদান অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্য কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
×