ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফুটপাথ তুমি কার

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

ফুটপাথ তুমি কার

‘দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ, ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে।’ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন সত্তর দশকের গোড়ায় এই কাব্য। তারই রেশ ধরে খোদ ঢাকা মহানগরীর ফুটপাথের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলা যায়, ‘ফুটপাথ দখল হয় দিনে রাতে।’ পায়ে চলার পথ বেদখল হয়ে গেলে বদলে যায় হাঁটার নিশানা। ফুটপাথ বা রাস্তাজুড়ে হকারদের পসার থরে থরে সাজানো। এক ইঞ্চি জায়গাও নেই যেন খালি। সে সব ডিঙ্গিয়ে পথ পাড়ি দেয়া যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলাচল করা তো অসম্ভবের পায়ে পায়ে ঘোরা। আর তা অকল্পনীয় করে তুলেছেন নগর রক্ষাকর্তারা। জানেন তাঁরাও ফুটপাথ নেই ফুটপাথে। মূলত সবই হাটবাজার। অবশ্য তাঁদের ফুটপাথ দরকারও হয় না। গাড়িতে চলাচল করার সুবোধ্য কারণে পথচারীর চলার পথ নির্বিঘœ করার ভাবনাটাকে অনায়াসে যেন ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাই ফুটপাথ নেই আর ফুটপাথে। মিশে গেছে তারা দোকানপাটের সাথে। ফুটপাথ মানেই দোকানপাটের আড়ত। সামান্যতম গলি থাকে হাঁটাচলার। তা-ও গা ঘেঁষে যেতে হয়। পথচারীর গায়ে গায়ে ঠোকাঠুকি। তার থেকে তর্কবিতর্ক, বচসার মত ঘটনারও ঘনঘটা দেখা যায়। তদুপরি পকেটমার, ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যও যেন এই ভিড়ের ফুটপাথ। নির্বিঘেœ তার কর্তব্যকর্ম সাধন করে। টের পেলেও থাকে না করার কিছুই সংঘবদ্ধদের কাছে। শীতের এই মৌসুমে ফুটপাথজুড়ে শীতবস্ত্র বিক্রেতার হাঁকডাক, চিৎকার, চেঁচামেচি শব্দদূষণকে ত্বরান্বিত করে। হালে রাস্তা ছেড়ে মোটর বাইক ফুটপাথকে দলিতমথিত করে চলে দুলকি চালে। মূল সড়কে যানজট দেখা দিলেই পালে পালে মোটরসাইকেল ফুটপাথকে শোভনীয় করতে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। পথচারীদের তখন নেমে যেতে হয় মূল সড়কে। ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্নগলির’ ঢাকায় ফুটপাথগুলো মূলত শপিং মলের বিকল্প। ঘরের সামনে ফুটপাথ হতে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেক মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তরা। গত সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে নগরবাসীকে রাস্তা চলাচলে সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ বিভাগ। ফুট ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার করে রাস্তা পারাপারের জন্য মাইকিং এখনও চলছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছে পুলিশ। ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে রাস্তা পার হওয়ায় কোন কোন নগরবাসীকে জরিমানার সম্মুখীন করেছে। অবস্থাটা এমন যে, ওভারব্রিজ থেকে নামতেই পড়ে তরিতরকারি বা অন্য সামগ্রীর দোকানপাট। ওঠার পথেও তাই। আর ব্রিজজুড়েও রয়েছে হকারদের সাজানো পসরা আর ভিক্ষুকের উপদ্রব। তদুপরি ওভারব্রিজগুলোর নড়বড়ে অবস্থাও রয়েছে কোথাও কোথাও। তাই ফুটপাথ ও চলাচলের পথ পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত না রেখেই নেয়া পদক্ষেপ যে কার্যকর করা সম্ভব, তা মনে হয় না। স্মরণে আসে, জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে ফুটপাথ উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট এক যুগ আগে ২০০১ সালে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, ফুটপাথ ও চলাচলের পথ পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার স্বার্থে দরিদ্র হকারদের ক্রমান্বয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। ঢাকার ফুটপাথ ও চলাচলের পথকে জনসাধারণের ব্যবহার এবং পথচারীদের জন্য অবশ্যই পরিচ্ছন্ন এবং উন্মুক্ত রাখার জন্য অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করার জন্য আদালত নির্দেশও দিয়েছিল। এমনকি সড়কের ফুটপাথে ভবন নির্মাণ সামগ্রী রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু আইনের হাল ‘কাজীর গরু কেতাবে’র মতো। দায়িত্ব ও আইনগত বাধ্যবাধকতা পালনে কেউই যেন আর সচেষ্ট নয়। কারণ ফুটপাথে বসা দোকানপাট থেকে ‘উপরি’ বা ‘বখরা’ মেলে। এই আয়ের পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই অর্থ সরকারের কোন খাতেই জমা হয় না। বরং কতিপয়ের পকেট ও ব্যাংক ব্যালেন্স ভারি করে। তাই প্রশ্ন জাগে, ফুটপাথ তুমি কার? পথচারী, হকার না চাঁদা আদায়কারীর? উত্তর সবার জানা। কিন্তু সমাধানের পথ দূরঅস্ত।
×