ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন শক্তিমান অভিনেতা খলিল

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

চলে গেলেন শক্তিমান অভিনেতা খলিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশীয় চলচ্চিত্রের এক শক্তিমান অভিনেতা খলিল উল্লাহ খান। চলচ্চিত্রকে মনে-প্রাণে ভালবেসে এ অঙ্গনকে রাঙিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল আজীবন। পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। অসাধারণ অভিনয়ে অর্জন করেছেন দর্শক হৃদয়, একবারই অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দেশপ্রেমিক থেকে শুরু করে কখনও শান্ত, কখনও কঠিন কিংবা খলনায়কে আবির্ভূত হয়েছেন সিনেমায়। রবিবার থেমে গেল এই বরেণ্য অভিনয়শিল্পীর জীবনের স্পন্দন। ভক্ত-অনুরাগী-সহকর্মী ও স্বজনদের বেদনায় ভাসিয়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হসপিটালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। দীর্ঘদিন যাবত তিনি কিডনিজনিত সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানান রোগে ভুগছিলেন। গত দু’দিন আগে তাঁর শারীরিক অবস্থা গুরুতর খারাপ হলে তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ইনটেনসিভ কেয়ারে তাঁর চিকিৎসা চলে। গুরুতর একটি অপারেশনের জন্য সকালে তাঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার সময় তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি রেখে গেছেন তিন ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। জীবনের শেষ ভাগে এই শিল্পীর আজীবন চিকিৎসার ভার নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও সহায়তা হিসেবে প্রদান করেন ১০ লাখ টাকা। খলিলের মৃত্যুতে গোটা চলচ্চিত্রাঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। পুরনো সহকর্মীরা যারাই তাঁর মৃত্যুর খবর শুনেছেন, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। স্কয়ার হসপিটাল থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর নিজগৃহ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাসভবনে। এরপর তাঁর মরদেহ বেলা ৩টায় নিয়ে যাওয়া হয় বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের আঙিনা বিএফডিসিতে। সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জনাতে ছুটে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অভিনয় জীবনের সাথী অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, নায়ক রাজ রাজ্জাক, হাসান ইমাম, কাজী হায়াৎ, উজ্জ্বল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলমগীর, ওমর সানি, হেলাল খান, সম্রাট, কণ্ঠশিল্পী মনির খানসহ চলচ্চিত্রাঙ্গন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেখানে তাঁকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এছাড়াও ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক ও শিল্পী সমিতি, আনসার ভিডিপিসহ বহু ভক্ত। এখানে তাঁর দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাজা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক কর্মজীবন ক্ষেত্র রাজধানীর খিলগাঁও আনসার ক্যাম্পে। সেখানে বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুরের বাইতুল ফজল জামে মসজিদে। এখানে তাঁর শেষ দফা জানাজা শেষে বাদ আছর মোহাম্মদপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। অভিনেতা খলিল উল্লাহ খানের মৃত্যুতে পৃথক পৃথক বাণীতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভিনেতা খলিল তাঁর সহজাত অভিনয় প্রতিভার গুণে এ দেশের চলচ্চিত্র দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কলিম শরাফী ও জহির রায়হান পরিচালিত ‘সোনার কাজল’ ছবিতে নায়ক হিসেবে খলিলের অভিষেক ঘটে চলচ্চিত্রে। এই ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়িকা হিসেবে ছিলেন সুলতানা জামান ও সুমিতা দেবী। সোনার কাজলের পর নায়ক হিসেবে ভাওয়াল সন্ন্যাসী, প্রীত না জানে রীত, কাজল, জংলীফুল, সঙ্গমসহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন খলিল। প্রতিটি ছবিই সেই সময় বেশ ব্যবসা সফল হয়। খলিল সম্পর্কে কিংবদন্তী নায়িকা শবনম বলেন, একজন মার্জিত শিল্পী খলিল ভাই। তাঁর বিপরীতে নায়িকা হিসেবেও আমি অভিনয় করেছি। সবসময়ই চিরাচরিত হাসি তার মুখে লেগেই থাকতো। এস এম পারভেজ পরিচালিত ‘বেগানা’ ছবিতে প্রথম খলনায়ক হিসেবে খলিল অভিনয় করেন। এই ছবিতে দর্শক তাঁর অভিনয়কে গ্রহণ করে নেন। যার ফলে একই ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের আরও সুযোগ আসে। তিনি কখনও না করেননি। ফলে এরপর একের পর এক খলনায়ক হিসেবেই ছবিতে কাজ করেন। নায়ক চরিত্রে আর অভিনয় করা হয়ে উঠেনি। তিনি দর্শকের ভালবাসার জন্যই কাজ করেছেন। আর দর্শকের ভালবাসার সর্বোচ্চ রায় হচ্ছে পুরস্কার বা স্বীকৃতি। চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হচ্ছে সেই স্বীকৃতি। চিত্রনায়িকা কবরী প্রযোজিত আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘গু-া’ ছবিতে খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন খলিল। একবারই পেয়েছিলেন এই সম্মাননা। তিনি বলেছিলেন, আমি দর্শকের ভালবাসা পাচ্ছি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। খলিল প্রসঙ্গে চিত্রনায়িকা কবরী বলেন, খলিল ভাইয়ের অভিনয়ের মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। আকর্ষণটা ঠিক এমন ছিল যে তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করতেন সেই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে তাঁর গলার আওয়াজ সহায়ক ভূমিকা পালন করত। যে কারণে তাঁর চরিত্রটিও হয়ে উঠত প্রাণবন্ত। খলিল ভাই কখনই তাঁকে দেয়া চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করতেন না। কারণ তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করতেন তাতে সহজাতভাবেই তিনি অভিনয় করতেন। আর তাতেই চরিত্রটি ফুটে উঠত। আর সেসব চরিত্রই দর্শককে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত। আমি সত্যিই বলছি, খলিল ভাইয়ের মতো অভিনেতা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আর দ্বিতীয় জন নেই। সত্যিই তার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। অভিনয় করলেও কখনই তাঁকে নির্দেশনায় পাওয়া যায়নি। ছবি পরিচালনা না করলেও দুটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন তিনি। একটি ‘সিপাহী’ অন্যটি ‘এই ঘর এই সংসার’। সিপাহী ছবিটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন কাজী হায়াৎ। ছবিটি বেশ ভাল ব্যবসা করেছিল। তবে তারচেয়েও বেশি ব্যবসাসফল হয়েছিল মালেক আফসারী পরিচালিত‘ এই ঘর এই সংসার’ ছবিটি। এই ছবিতে নায়ক হিসেবে ছিল প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ। তাঁর বিপরীতে ছিল বৃষ্টি। খলিল সর্বশেষ নায়ক রাজ রাজ্জাকের সঙ্গে ‘বাপ বড় না শ্বশুর বড়’ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন। এরপর আর নতুন কোন ছবিতে কাজ করেননি। শিল্পী সমিতির দ্বিতীয় সভাপতি ছিলেন তিনি। চিত্রনায়িকা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক কোহিনূর আক্তার সুচন্দা বলেন, আসলে সবাই আমরা এখন তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি। এটাই হয়তো নিয়ম, বয়স হলে চলে যেতে হয়। নায়িকা হবার অনেক আগে থেকেই আমি খলিল ভাইয়ের চলচ্চিত্র দেখেছি। চিত্রনায়িকা ববিতা বলেন, সেই পুতুল খেলার বয়স থেকে খলিল ভাই, গোলাম মুস্তাফা ভাই, শওকত আকবর ভাইয়ের সঙ্গে আমার কাজ করা। তাদের আদর স্নেহেই আমি বেড়ে উঠেছি।
×