ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সৌদি ওয়াহাবী মতবাদের র‌্যাডিক্যাল চেহারা

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

সৌদি ওয়াহাবী মতবাদের র‌্যাডিক্যাল চেহারা

ইসলামী স্টেট (আইএস) আজ এক সর্বনাশা শক্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রূপ ধারণ করে এখন তারই পৃষ্ঠপোষকতাকারী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আইএস এখন গোটা বিশ্বে তাদের ওয়াহাবী ভাবধারার ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। বর্তমান ওয়াহাবী মতবাদ বৈধতা ও শক্তিলাভ করেছে সৌদি সরকারের কাছ থেকে। এই মতবাদের উৎপত্তি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ওয়াহাবী ইসলাম আরবের মধ্যাঞ্চলে একটা শক্তিতে পরিণত হবার পর অটোমান শাসনের ওপর আঘাত হেনে বসে। অষ্টাদশ শতকের ইসলামী প-িত আবদুল ওয়াহাব এবং সৌদি আরবের প্রথম বাদশাহ ইবনে সৌদের মিলিত শক্তি অটোমান শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ইসলামের প্রচলিত বিশ্বাস ও রীতিনীতি সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলেন। তুর্কীরা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে রক্ষাই শুধু করেনি, এতদিন ধরে তারা যে অতিন্দ্রীয় ইসলাম চর্চা করে এসেছে সেটিকে রক্ষার জন্যও অক্লান্ত লড়াই চালায়। অটোমান শক্তি ওয়াহাবীদের আরব মরুভূমির বুকে আটকে রাখে। সেখানে তারা প্রায় এক শতাব্দী আটকা পড়েছিল। তুর্কীদের চোখে ওয়াহাবীদের গোঁড়ামি ছিল অনৈসলামিক ও অপরাধমূলক। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। বর্তমান তুর্কী সরকার সেই ওয়াহাবী বাজনাদারদের গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। তারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসকে টিকিয়ে রাখার কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে। আইএসের আজকের যে এজেন্ডা সেটা প্রায় ২শ’ বছর আগে আবদুল ওয়াহাব রচিত পরিকল্পনার সম্প্রসারণ মাত্র। ওয়াহাবীদের বর্ণিত ‘বিশুদ্ধ’ ইসলাম এবং আজকের আইএস সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে যে সাদৃশ্য আছে সেটা এখন পর্যালোচনা করে দেখা যাক। ওয়াহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব। তাঁর এই র‌্যাডিক্যাল ও বিশুদ্ধবাদী ইসলামী ভাবধারা বিশেষ শক্তি লাভ করে যখন ইবনে সৌদ তাঁর বেদুইন দলে এই ধর্মীয় উদ্দীপনা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় ভয়ঙ্কর দরিদ্র মরু অঞ্চল নেজদ-এ বেদুইনরা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। তাদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি, হামলা-পাল্টা হামলা অহরহ লেগেই থাকত। ইবনে সৌদ সে সময় এমনি একজন উপজাতীয় নেতার চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন না। পরবর্তীকালে ইনিই হন সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা। যাই হোক, যে সময়কার কথা বলা হচ্ছে সে সময় ইবনে সৌদের সহযোগিতায় আবদুল ওয়াহাব তাঁর ওয়াহাবী মতবাদের সঙ্কীর্ণ ও বিদ্বেষমূলক এজেন্ডা রচনা করেন। তিনি তাঁর বিরোধীদের এবং তাঁর মতবাদ মানতে অনিচ্ছুক সকল মুসলমানকে বিধর্মী ও কাফের আখ্যায়িত করেন এবং প্রচার করেন যে, যারা ইসলাম সম্পর্কিত তাঁর ব্যাখ্যা মানবে না তাদের হত্যা করা হবে এবং তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য করা হবে। তাঁর বিবেচনায় শিয়া, সুফী ও অন্যান্য মুসলমান বিশুদ্ধ ইসলামের অনুসারী নয় এবং সেই কারণে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং অন্য সব ধর্মমতকে ধ্বংস করতে হবে। এই ভয়াবহ মতবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী মৌলবাদের ভিত্তি রচিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদের রূপ ধারণ করে শুধু মুসলমানদের জীবনই নয় বরং বিশ্বে সকলের জীবন বিষিয়ে তুলছে। আজকের তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর অধিকাংশই এই রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত। সৌদি অর্থ ও শক্তি ইসলামের এই বিদ্বেষপূর্ণ সংস্করণকে প্রকৃত ও বিশুদ্ধ ইসলাম হিসেবে মূলধারায় পরিণত করতে সফল হয়েছে। ইসলামের এই সংস্করণ থেকে যে কোনরকম বিচ্যুতিকে অনৈসলামিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলাম বিষয়ক অনেক লেখক চিরায়ত ইসলামের কথিত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সৌদিদের সংস্কারের দাবির বাহ্যিক রূপটাই শুধু দেখে থাকেন। অনেকে আবার এটাকে খ্রীস্টানদের সংস্কার আন্দোলনের সমার্থক বলে গণ্য করেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁরা সংস্কার ও ধর্মান্ধতার মধ্যে পার্থক্য টানতে পারেন না। আইএস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন আজ ইসলামের নামে ওয়াহাবীদের এই আদি বিকৃতিকে আরও উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে গেছে। যেখানে তারা তাদের মূল শিকড় বা উৎপত্তি স্থলের কথাও বলে না। সৌদি শাসকগোষ্ঠী এখন তাদেরই মতাদর্শে সৃষ্ট দানবের দিক থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তারা প্রকাশ্যে আইএসের সন্ত্রাসবাদ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি মক্কার গ্র্যান্ড ইমামকে দিয়ে আইএসের সন্ত্রাসকে শরিয়তী আইনের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। সৌদি শাসকগোষ্ঠী বেকায়দায় পড়লেই বরাবর এই কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারপরও আইএস ও তার সমগোত্রীয়দের সঙ্গে সৌদি-ওয়াহাবীদের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। ১৯২০-এর দশকে ওয়াহাবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সৌদি শাসকগোষ্ঠী মদিনায় জান্নাতুল বাকি সমাধিক্ষেত্রে ১৪শ’ বছরের পুরনো সমাধিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইএস আজ মাজার ধ্বংস করছে। শিয়া মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ওয়াহাবী মতবাদের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তারা কারবালায় ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এরপর মহানবীর দৌহিত্র হোসেনের সমাধিতে লুটপাট ও ভাংচুর চালানো হয়। ওয়াহাবী-সৌদি ইতিহাসের গোটা অধ্যায়জুড়ে শিয়া বিদ্বেষ একটা সার্বক্ষণিক বৈশিষ্ট্য থেকে গেছে। সেই একই বৈশিষ্ট্য তাদের সর্বশেষ পতাকাবাহী আইএস ও আল কায়দাও ধারণ করে চলেছে এবং সেটা কার্যকর করছে। সৌদি ও কাতারি শাসকগোষ্ঠী আজ বুঝতে পেরেছে যে, আইসিস গঠনের মধ্য দিয়ে তারা একটা দানব সৃষ্টি করেছে, যা এখন তাদেরই শান্তিপূর্ণ অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএস এখনও প্রবলভাবে ওয়াহাবীপন্থী হলেও মনে রাখতে হবে যে, ওরা অতিমাত্রায় র‌্যাডিক্যাল। এদের সমকালীন ওয়াহাবী ভাবধারার মূলত এক সংশোধনমূলক আন্দোলন হিসেবেই দেখা যেতে পারে। সূত্র : দ্য হিন্দু
×