ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মান্নান

আমার বন্ধু জগলুল আহমেদ চৌধূরী

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

আমার বন্ধু জগলুল আহমেদ চৌধূরী

আমন্ত্রিত হয়ে ২৯ তারিখ রাতে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সফররত কিছু বিদেশী অতিথির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। সব শেষে রাতের খাওয়ার বিশাল আয়োজন। সাধারণত এই ধরনের অনুষ্ঠানে আমার দীর্ঘকালের বন্ধু সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধূরী উপস্থিত থাকে। সেদিন তাকে না দেখে আয়োজকদের একজনের কাছে জানতে চাইলাম জগলুল আসবে কী না? উনি জানালেন কোন এক টিভিতে তার একটি রেকর্ডিং আছে। সময় করে আসতে পারলে আসবেন। শেষতক সেই রাতে জগলুল আর আসেনি। আসা সম্ভব ছিল না, কারণ ততক্ষণে সে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে চলে গেছে। জগলুলের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৭ সালে। তখন আমরা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। জগলুল রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের আর আমি বাণিজ্যের। তখন হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ভিড়-ভাট্টা ছিল না। হলের সকলেই সকলকে কম বেশি চিনত। জগলুলের সঙ্গে পরিচয়টা একটু গাঢ়। আমার অনেক বন্ধু রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তাদের সঙ্গেই জগলুলের সঙ্গে পরিচয়। জানা মতে, পরবর্তী জীবনে সকলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। কয়েকজন শহীদও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে জগলুল সাংবাদিকতা পেশা বেছে নিল। শিক্ষকতায় গেলাম আমি। দেখা হতো মাঝে মাঝে। তবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে তার বিশ্লেষণধর্মী লেখা পারতপক্ষে মিস করতাম না। কোন কোন লেখার বক্তব্যের সঙ্গে এক মত না হলে সে কথা তার সঙ্গে দেখা হলেই বলতাম। যখন থেকে বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টক-শোতে অংশগ্রহণ শুরু করেছি তখন তার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হওয়া শুরু হলো। সামাজিক অনুষ্ঠান তো ছিলই। জগলুলের কথা বলার একটি পৃথক স্টাইল ছিল। সিলেটের মানুষ গলার ভেতর থেকে কথা বলে। জগলুলও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ঠাট্টা করে তাকে তা বললে সে শুধু হাসত। ২৯ তারিখ জগলুল যাচ্ছিল কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা স্টুডিওতে শ্যামল দত্ত পরিচালিত ‘অন্য দৃষ্টি’ অনুষ্ঠানে। আলোচনার বিষয় ছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সদ্য সমাপ্ত সার্ক সম্মেলনে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে। জগলুল সেই আলোচনায় আর অংশ নিতে পারেনি। নিজের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভার না আসাতে সে দিন বাসেই সে রওনা হয়েছিল। আমরা যারা ঢাকা শহরে থাকি তাদের মাঝে মধ্যে এই ধরনের ব্যবস্থায় চলাফেরা করতে হয়। সম্ভবত ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র রাজধানী, যেখানে কার্যকর কোন গণপরিবহন নেই। যেগুলো আছে তাদের কাছে যাত্রীরা একশত ভাগ জিম্মি। আর এই সব পরিবহনের মালিক আর চালকরা অত্যন্ত ক্ষমতাশীল কারণ তাদের পেছনে আছে রাজনৈতিক প্রশ্রয় আর ছায়া। তাদের আচার-আচরণ দেখে কারও কারও মনে হতে পারে তারা সরকারের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাধর। অনেক চেষ্টা করেও সিএনজি ত্রিহুইলার বলি আর ট্যাক্সি ক্যাব, কোনটাকে মিটারে চলতে বাধ্য করা যায়নি। সেনাবাহিনীর পরিচালনায় একটি ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস চালু হয়েছিল। সেই সার্ভিস ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ ট্যাক্সি ক্যাব পরিচালনা করা সেনাবাহিনীর কাজ নয় এবং এই ট্যাক্সি ক্যাবে চড়তে হলে যেভাবে পকেট খালি করতে হয় তা অকল্পনীয়। ইদানীং আবার সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও মনোযোগী হয়েছে। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। জগলুলকে রাত সাড়ে আটটার দিকে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ে বাস থেকে নামিয়ে দেয় এবং সম্ভবত সে সম্পূর্ণ নামার আগেই বাসটি আবার চলতে শুরু করে, যার ফলে জগলুল পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ইমরুল কায়েস একজন শিক্ষিত বেকার যুবক। কাজ খুঁজছে এই প্রাণহীন ঢাকা শহরে। একজন গুরুতর আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে চেষ্টা করেন চলমান কোন একটা গাড়ি থামিয়ে কাছের কোন এক হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারও কোন সময় নেই। কেউ কেউ আবার ভয়েও থামে না। একবার আমার এক পরিচিতজন এই রকম একজন আহত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তার গাড়িতে। রোগী সেখানে মারা যায়। পরে পুলিশ উদ্ধারকারীকেই নিয়ে টানাটানি শুরু করে। শেষমেশ ইমরুল গুরুতর আহত জগলুলকে রিক্সায় করে পাশের মোহনা নামক একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখে সেখানে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। পরে তাকে অন্য আর একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সময় মতো চিকিৎসা পেলে হয়ত জগলুলকে বাঁচানো যেত। বন্ধু জগলুলের মৃত্যু অনেক চলমান প্রশ্নকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে দেশে তো বটেই, বিদেশেও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ঢাকায় যত সংখ্যক বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন আছে সেই তুলনায় আমাদের সড়কের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। নিত্যদিনের এই ট্রাফিক জামের ঘটনা সামাল দিতে এই শহরের ট্রাফিক পুলিশ যে পরিশ্রম করেন তা বিদেশের অন্য কোন শহরে দেখা যায় না, এমনকি পাশের দেশ ভারতের কলকাতায়ও না। এই শহরে যে বেপরোয়াভাবে ট্রাক, বাস অথবা লেগুনা নামক ছোট হিউম্যান হলার চলে তা এক কথায় নজিরবিহীন। সঙ্গে আছে ধীর গতিসম্পন্ন আনাড়ি হাতে চালিত রিক্সা আর বেয়ারা ত্রিহুইলার সিএনজি। প্রাইভেটকারওয়ালারা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। কারণ গাড়ি নিজস্ব এবং তারা কিছুটা হলেও দায়িত্বশীল। গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ কিন্তু তা ক’জন গাড়ির চালক মানেন? বাস আর হিউম্যান হলারের ওভার টেকিং দেখলে যাত্রীদের দোয়া দরুদ পড়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঢাকা শহরে যে সব ড্রাইভার হিউম্যান হলার চালায় তাদের ক’জনের লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়েছে ? জগলুলকে যে বাস চলন্ত অবস্থায় নামিয়ে দিল সেটিকে শনাক্ত করা যায়নি। সে যখন গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন অন্য যাত্রীরা তাকে কেন বাধা দিলেন না? ক’দিন পুলিশ পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ অথবা আন্ডারপাস ব্যবহার করতে বাধ্য করল। কিন্তু ঢাকা শহরে ক’টি ফুটওভার ব্রিজ অথবা আন্ডারপাস আছে? সাত মসজিদ রোডের শংকরে একটি ফুটওভার ব্রিজের অর্ধেক কাঠামো হয়ে পড়ে আছে গত তিন বছর। এই স্থান দিয়ে প্রতিদিন রায়েরবাজার হতে লক্ষাধিক মানুষ জীবনবাজি রেখে এপার ওপার করেন। বিশ্বের সকল দেশেই রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং আছে। সেই ক্রসিং দিয়ে পথচারী পারাপারের সময় গাড়ির চাকা একটি দাগে লাগলেই মোটা অঙ্কের দ- গুনতে হয়। ঢাকার কোন ফুটপাথ হকারমুক্ত নয়। অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা এই সব ফুটপাথ দখল করার জন্য পুলিশ আর পাড়ার মস্তানদের নিয়মিত বখরা দিয়ে থাকেন। কলকাতায় আর কুয়ালালামপুরে দেখেছি দিনের একটি সময়, বিশেষ করে অফিস আর স্কুলের সময় কোন কোন ব্যস্ত রাস্তাকে একমুখী করে দিতে। বাঁয়ে মোড় বন্ধ। সেই পরীক্ষা ঢাকায় করা সম্ভব কী না জানি না। এই যে বাস বা হিউম্যান হলারগুলো একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তার প্রধান কারণ হচ্ছে, যে যত বেশি ট্রিপ মারতে পারে তার তত লাভ। ট্রিপের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় নামিয়ে আনা যাবে না কেন? যত্রতত্র যাত্রী নামানো ওঠানো কোন সভ্য দেশে নেই। এই প্রাণঘাতী ব্যবস্থা বন্ধ করতে ট্রাফিক পুলিশের তেমন কোন বেগ পাওয়ার কথা নয়। তবে অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই সব পারা যায় না। কারণ মালিক চালকদের পেছনে থাকে কোন মন্ত্রী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আশ্রয়। চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিক্সা বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ওই শহরে এই রিক্সাওয়ালাদের হাতে পুলিশ জিম্মি। এবার আসি হাসপাতালে চিকিৎসার কথায়। জগলুলকে যে ‘মোহনা’ হাসপাতালে প্রথম নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা ছিল একটি ভুয়া হাসপাতাল। ঢাকা শহরে এমন হাসপাতাল অসংখ্য আছে। এই সব হাসপাতাল কেমন করে পরিচালিত হয়? সব দেশেই হাসপাতাল মানেই সেখানে জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হয়। থাকতে হয় সার্বক্ষণিক চিকিৎসক। বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা দীর্ঘ ৪৩ বছরেও গড়ে উঠল না। এটি তো আমাদের বড় ব্যর্থতা। আর বেশিরভাগ হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা এখন আর জনগণকে সেবা দেন না, তাদের পকেট কাটেন। ব্যতিক্রম যে অল্পসংখ্যক আছেন তাদেরকে সতীর্থরা বাঁকা চোখে দেখেন। এক জগলুলের মৃত্যুর পর আরও গোটা দশেক মানুষ বেয়াড়া ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু কোন ড্রাইভারের কখনও কোন বিচার হবে না। কারণ আইন অতদূর পৌঁছায় না। মালিক ড্রাইভারদের হাত আইনের চেয়েও অনেক লম্বা। ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক।
×