ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পার পেয়ে যায় অপরাধীরা

চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাসচালকের হদিস মেলে না

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাসচালকের হদিস মেলে না

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নাটোরের বড়াইগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনার পর আহত যাত্রীদের চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া হানিফ পরিবহনের বাস ও চালকের হদিস মেলেনি ঘটনার দেড় মাসেও। এ ঘটনায় ৩৬ জনের বেশি যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এদিকে সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীকে চাপা দেয়া বাস ও চালকেরও হদিস মেলিনি ঘটনার এক সপ্তাহ পরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের অসহযোগিতা ও রাজনৈতিক প্রভাব সর্বোপরি পুলিশের গাফিলতির কারণেই সড়ক দুর্ঘটনার পালিয়ে যাওয়া বাস ও চালককে অনেক সময় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বিচার হয় না। এ ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কঠোর কোন শাস্তি না থাকায় পুলিশ আসামি ধরতে নিরুৎসাহিত বোধ করে। মালিক সমিতির কাছেও চালকদের সম্পর্কে কোন তথ্য মেলে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরিসহ সকল পরীক্ষা যথাযথ নিশ্চিত করে লাইসেন্স দেয়া হলে সড়ক-মহাসড়কে কমবে মৃত্যুর মিছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া চালক ও গাড়ি শনাক্ত করতে হলে প্রতিটি যাত্রীবাহী বাসে চালকের বায়োডাটা ঝুলিয়ে রাখা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে চালকের শাস্তি। অপরাধ অবশ্যই হতে হবে জামিনের অযোগ্য। মালিক সমিতি অফিসে প্রতিটি বাসের চালকের জীবনবৃত্তান্ত রাখা (১৯ পৃষ্ঠা ১ কঃ দেখুন) চাপা দিয়ে (২০-এর পৃষ্ঠার পর) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোন মালিক লাইসেন্স ছাড়া চালককে গাড়ি দিলে দুর্ঘটনার পর চালকের পাশাপাশি মালিকের বিরুদ্ধেও নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। পালিয়ে যাওয়া গাড়ি ও চালককে খোঁজে বের করতে গোয়েন্দা পুলিশকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তারা। চালকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তঃজেলা রুটে চালকরা মাসিক কোন বেতন পান না। দিন হাজিরায়, গাড়ি চালালে বেতন। অন্যথায় নয়। তাই চালকদের মাসিক হিসেবে বেতন দেয়ার পরামর্শ তাদের। তারা বলছেন, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে চালকদের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের শেষ নেই। চালকের কারিগরি পরীক্ষার সময় গাড়ি ভাড়া করে আনা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রাইভেট কারের জন্য আবেদনকারী চালকের পরীক্ষা নেয়া হয় ভাড়ায় আনা ট্রাক দিয়ে! এক্ষেত্রে বেশিরভাগ চালক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেও টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেয়া হয়। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চালককে না দেখেও দেয়া হচ্ছে লাইসেন্স। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যার করার সনদ তুলে দেয়া হয় চালকদের হাতে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ সার্জেন্ট নূরুল মোমেন অসীম এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া গাড়ি ও চালকদের ধরতে না পারার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। একদিকে কোন চালক গাড়ি চালাচ্ছেন এ ব্যাপারে মালিক অনেক সময় কিছুই জানেন না। অন্যদিকে লাইসেন্সবিহীন চালক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটালে তা আড়াল করার চেষ্টা হয় সবচেয়ে বেশি। কারণ চালক সম্পর্কে কোন তথ্যই বিআরটিএ অফিসে থাকে না। এমনকি পরিবহন মালিকের কাছে নেই। মালিক সমিতি কার্যালয়েও কোন গাড়ি কোন চালক চালাচ্ছেন এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় না। অধরাধীকে ধরলে পুলিশও অনেক সময় যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। কারণ কষ্ট করে ধরার পর ঘাতক চালক জামিনে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ আইনে কঠোর কোন শাস্তির বিধান নেই। এ কারণেও পুলিশ অনেক সময় চালকদের ধরতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোন রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া এমনকি চালককে না দেখেই লাইসেন্স দেয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়ছে। গত ২০ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রামের রেজুর মোড়ে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহন এবং বিপরিত দিক থেকে আসা অথৈ পরিবহনের দুটি বাসের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ৩৬ জন। আহত হন আরও ৪৪ যাত্রী। রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা আহত ব্যক্তিদের চাপা দিয়ে চলে যায় দ্রুতগামী হানিফ পরিবহন। এই বাসে পিষ্ঠ হয়ে আহত অনেক যাত্রীই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, চালকদের বেপরোয়া গতি এবং ওভারটেক করার চেষ্টাই দুর্ঘটনার কারণ। সেই সঙ্গে হানিফ পরিবহনের বাসটি আহত যাত্রীদের চাপা দেয়ার কারণে অনেকই প্রাণ হারান। ঘটনার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও হানিফ পরিবহনের সেই বাস ও চালকে আটক করা সম্ভব হয়নি। শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের মন্ত্রীর সান্ত¡না ॥ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির আশ্বাস দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় জগ্লুল আহ্মেদের বনানীর বাসায় যান তিনি। এ সময় ওবায়দুল কাদের নিহত সাংবাদিকদের স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে এবং মেয়ের জামাতার সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রী এ সময় তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও সান্ত¡না জানান। মন্ত্রী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে চাপমুক্ত রাখতে সিনিয়র সাংবাদিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তকে রাখা হয়েছে। মন্ত্রী তাদের বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসলেই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রী নিজে, তার মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা জানান ও শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। নির্ধারিত সময়ে এ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে বলেও জানান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। উল্লেখ্য, শনিবার (২৯ নবেম্বর) রাত ৮টার দিকে কাওয়ানবাজার এলাকায় বাস থেকে নামার সময় পড়ে গেলে একই বাসের পিছনের চাকায় জখম হন বাসসের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী। তার মাথায় ও মুখের এক পাশে মারাক্তক আঘাত লেগে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এ সময় পথচারীরা উদ্ধার করে প্রথমে কাছের মোহনা ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে জরুরী বিভাগের ডাক্তার না থাকায় গ্রিনরোডের কমফোর্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার ইমরান হোসেন তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
×