ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ॥ ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানির রোডম্যাপ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ॥ ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানির রোডম্যাপ

এম শাহজাহান ॥ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানির রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের আওতায় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। আর মাত্র সাত বছর পর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশ কী অর্জন করলো এখন থেকেই কষা হচ্ছে সেই হিসেবে-নিকেশ। এ সময়ে জাতীয় বাজেট, প্রবৃদ্ধি, রফতানি আয়, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণ, মাথাপিছু আয় এবং মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির সব সূচকে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। পোশাক রফতানিতে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর বছরে রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে এক নম্বরে আসবে বাংলাদেশ। জানা গেছে, এ লক্ষ্য অর্জনে একটি কার্যকর রোডম্যাপ তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তারাও বলছেন, ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এ লক্ষ্যে পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবারই প্রথমবারের মতো আগামী ৭Ñ৮ ডিসেম্বর দুইদিনব্যাপী আয়োজন করেছে ঢাকা এ্যাপারেল সামিট। এই সামিটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে পোশাকশিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত এবং এগিয়ে যাওয়ার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ। এ শিল্পখাত এগিয়ে নিতে ক্রেতাসহ এ্যাপারেল সামিটে সারাবিশ্ব থেকে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যোগ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, তাজরীনে ভয়াবহ অগ্নিকা- এবং যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত হওয়ার পর এ শিল্পখাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও রফতানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। জানা গেছে, রফতানি বাণিজ্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে শুধু পোশাকশিল্পে আরও ২৯ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে এ শিল্পে ৪০ লাখ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এছাড়া পোশাকশিল্পে এখন প্রতিবছর গড়ে ১৫Ñ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ২০ বছর নাগাদ এ শিল্পের গ্রোথ এ হারেই বাড়বে। এই গ্রোথ ধরে রাখার জন্য গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনসহ অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এদিকে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান-২০১৪ তথ্য মতে, গত ২০১৩ সালে বিশ্ব পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই সময়ে বার্ষিক রফতানি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ৩৫৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রফতানি বেড়েছে। যদিও গত দুই মাস ধরে পোশাক রফতানি সামান্য নেগেটিভ ধারায় রয়েছে। তবে অর্ডার বৃদ্ধি এবং নতুন বাজার সম্প্রসারণ হওয়ায় উদ্যোক্তারা আশা করছেন, বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পোশাক তৈরির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ফলে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া কেউই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। এখন একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। কিন্তু চীন এখন ৪০ বছরের নিচে কোন শ্রমিক পাচ্ছে না গার্মেন্ট শিল্পে। সে কারণে চীনও প্রতিদ্বন্দ্বীর তালিকা থেকে সরে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যেসব পোশাকশিল্প পণ্য বিক্রি হয় তার ৪০ শতাংশই হচ্ছে বেসিক গার্মেন্টস। এই বেসিক গার্মেন্টসের চাহিদা সারাবিশ্বে প্রতিবছর বাড়ছে প্রায় ২৫Ñ৩০ বিলিয়ন ডলারের। আর বেসিক গার্মেন্টসের জন্য বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাজার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব নয়। কারণ ২০২১ সালে বিশ্বে পোশাকশিল্পের বাজার বেড়ে দাঁড়াবে ৬৫ হাজার কোটি ডলারে। বর্তমানে আছে ৪৫ হাজার কোটি ডলারের বাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। এটি ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে পারলেই লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। এদিকে গত সাড়ে পাঁচ বছরে পোশাক শিল্পে নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। নানামুখী চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ওই সময়ে পোশাক রফতানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। নতুন মজুরী বোর্ড গঠন করায় শ্রমিকদের বেতন তিনগুণ বেড়েছে। ওই সময়ে বেড়েছে দেশের মোট রফতানিও। পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকায় এটা সম্ভব হয়েছে। সরকার শিল্পবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে এ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। সূত্র মতে, গত ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই দেশের রফতানি খাতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়। নতুন বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি বাড়তে থাকে পোশাক রফতানি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএর তথ্য মতে, ২০০৮Ñ০৯ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এটা বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ ২০১২Ñ১৩ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ২২ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। গত অর্থবছর তা ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে, বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, পোশাক শিল্পখাতের অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে এ শিল্পে ৬৯ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বর্তমান এ শিল্পে ৩০ লাখ নারী ও ১০ লাখ পুরুষ কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পোশাক শিল্পখাতসহ দেশের শ্রমঘন শিল্পখাতে দেড় কোটি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। একে কাজে লাগাতে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর ওপর ভিত্তি করে একটি কর্মকৌশল তৈরি করছে সরকার। ইতোমধ্যেই ১৭টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের দাম বাড়ায় চীন থেকে আগামী দশ বছরে ৮০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান বেরিয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা হিসাব করেছি বাংলাদেশে শ্রমঘন শিল্পে ১৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সম্ভব। কিন্তু এর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগ দরকার। অবকাঠামো, জমি, দক্ষ শ্রমিক, অর্থায়ন ও জ্বালানি এগুলোর প্রয়োজন। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি স্থগিতে পোশাক রফতানিতে প্রভাব পড়েনি। বরং ওই সময়ে দেশটিকে পোশাক রফতানি বেড়েছে। এছাড়া নতুন বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে।
×