ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সামাজিক পরিবর্তনে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

সামাজিক পরিবর্তনে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মানুষের ব্যক্তিগত আয় বাড়ছে। ফলে পরিবর্তন আসছে সমাজ ব্যবস্থায়। ব্যক্তিগত আয় বাড়ায় অনেকেই স্বাভাবিকভাবেই উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের অনেকেই আধুনিক বা উচ্চবিত্ত বা পাশ্চাত্যের জীবনধারার মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বাড়তি রোজগারের কারণে মানুষ জীবনকে আলাদাভাবে উপভোগ করার চেষ্টা করছেন। সমাজের এ শ্রেণীর মানুষরা সম্প্রতি ক্লাবে যাওয়া, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়তি সময় কাটানোসহ নানাধরনের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এমন অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়াদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় এমন অভ্যাসের বিষয়টি এখনও মেনে নিতে পারেননি পরিবার। ফলে এ ধরনের অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়া পুরুষদের পরিবারে নানাধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে অপরাধ বিশেজ্ঞদের অভিমত। সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন মূল্যবোধ সঙ্কটেরও সৃষ্টি করছে। আর মূল্যবোধ সঙ্কটেও তৈরি হচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। কিছু কিছু কেস স্টাডিতে বিশেষজ্ঞদের এ অভিমতের প্রতিফলন ঘটে। যেমন গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন মধ্যমণিপুরীপাড়ার লিপ্পন লিমিটেডের ৭৯৬ নম্বর ৮ তলা দিলারা কুটিরের দ্বিতীয় তলার ২/এ নম্বর ফ্ল্যাটে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বেঁধে মারধরের পর অভিমানে আত্মহত্যা করেন ফার্মগেট ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সাইফুল ইসলাম। ২০ হাজার টাকার ওই ফ্ল্যাটে ভাড়ায় বসবাস করছিলেন সাইফুল ইসলাম। স্ত্রী সরকারী চাকরিজীবী। সাইফুলের পিতা নাগরপুর সরকারী কলেজের ইন্সট্রাক্টর ছিলেন। তাঁদের ঘরে ৬ মাসের ফুটফুটে শিশুপুত্র তাসাউফ রয়েছে। নিহতের পরিবার জানায়, প্রথম স্ত্রী মারা গেলে সাইফুল ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিয়ের পর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নিজেকে জানার পরও বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সাইফুল বদলায়নি। পরকীয়া আর মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। তারই জের ধরে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা বসবাস শুরু করেন। প্রায় ৬ মাস ধরে ফার্মগেটে একাই বসবাস করছিলেন সাইফুল। ঘটনার দিন বিকেলে স্ত্রী সাইফুলকে ডেকে পাঠায়। সাইফুল সেখানে যায়। এক অনুষ্ঠানে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত। ঝগড়ার এক পর্যায়ে পরকীয়া আর মাদকের বিষয়টি চলে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাইফুল স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করে। হত্যার উদ্দেশে তাঁর হাত পা বাঁধে। এরপর তার স্ত্রী ৬ মাসের শিশুপুত্র তাসাউফের জন্য স্বামীর কাছে জীবন ভিক্ষা চায়। পরে স্বামী সাইফুল ইসলাম নিজেই মাদকাসক্ত থাকায় অভিমানে আত্মহত্যা করে। গত ৫ নবেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন মধ্যপাইকপাড়ার আহাম্মদনগরের ৬৭/এ নম্বর ৬ তলার বাড়ির পঞ্চম তলার ৫/সি নম্বর ফ্ল্যাটে পূবালী ব্যাংকের এ্যালিফ্যান্ট রোড শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক আমানুল্লাহ তাঁর সাত বছর বয়সী বড়ছেলে সাবিদ আর স্ত্রী আইরিন সুলতানা আরজুকে (৩৫) প্রচ- মারধরের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে। পুলিশ আমানুল্লাহকে গ্রেফতার করে। আমানুল্লাহ ভুল স্বীকার করে স্ত্রী সন্তান হত্যাকা-ের পুরো ঘটনাই বর্ণনা করেন। বলেন, সুবর্ণা নামের এক মেয়ের সঙ্গে বছরখানেক ধরে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক চলছিল তাঁর। এর সূত্রধরেই পরিবারে অশান্তি চলছিল। বছরখানেক ধরে স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে বসবাস করছিলেন না। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরেই ঝগড়া থেকে স্ত্রীকে মারধরের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে। মাকে হত্যা করার দৃশ্য দেখে ফেলে বড়ছেলে সাবিদ। সে পুলিশের কাছে পুরোঘটনা বলে দিতে পারে। এজন্য সে বড়ছেলেকেও শ্বাসরোধে হত্যা করে। পাশের রুমে থাকা দেড় বছরের ছেলে আবিদ কোন কিছুই বলতে পারে না বিধায় বেঁচে যায়। এছাড়া গত অক্টোবরে কল্যাণপুরে পরকীয়া আর মাদকের পথ থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে হত্যার ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’র টুনির চরিত্রে অভিনয় করে আলোড়ন তোলা নায়ার সুলতানা লোপা, অভিনেত্রী মিতা নূর ও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যশোরের সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট খান মোহাম্মদ টিপু সুলতানের পুত্রবধূ ডাঃ শামারুখ মেহজাবিনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়ত এরা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু আত্মহত্যার করার পেছনেও কারণ থাকে। পারিবারিক অশান্তি বা স্বামী বা স্ত্রীর অশান্তি পরিবারের সদস্যদের অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে প্ররোচিত করে। এক্ষেত্রে পুরুষরা হত্যা বা অপরাধ করে থাকে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি বা সংসার জীবনে মানুষের এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় না। এমনই কোন ঘটনাই হয়তো টুনি, মিতা নূর ও ডাঃ শামারুখ মেহাজাবিনকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করতে পারে। আবার তাদের হত্যাও করা হতে পারে। তবে তাঁদের মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয় সে বিষয়টি নিশ্চিত। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের অক্টোবরেই রাজধানীতে ২১টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্তত ১৫টিই চাঞ্চল্যকর খুন। সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, পারিবারিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ অনেক গভীরে। দেশ আধুনিক ধারার দিকে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে সমাজব্যবস্থাও। মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারও পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। এ ধারায় অনেকেই নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে রীতিমত হোঁচট খাচ্ছেন। ফলে নানাধরনের অঘটনের জন্ম হচ্ছে। সংঘটিত হচ্ছে নানাধরনের পারিবারিক অপরাধ। সমাজব্যবস্থা বা পারিবারিক জীবনযাপন পদ্ধতি বদলে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত আয় উপার্জন বেড়ে যাওয়া। বাড়তি রোজগার করা ব্যক্তিদের অনেকেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রত্যাশা করে থাকেন। অনেকেই ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিপথগামীও হয়ে পড়ছেন। হালে সমাজের অনেক সচ্ছল পরিবারের সদস্য বা ব্যক্তিগতভাবে বেশি রোজগার করেন এমন ব্যক্তিদের অনেকেই নাইটক্লাবে যাতায়াত করেন। এসব জায়গায় যাতায়াতের কারণে আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। যদিও বিষয়টি বহু পুরনো কালচার। এক সময় সমাজের সবচেয়ে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষজন এসব জায়গায় যাতায়াত করতেন। এখন সে ধারা পাল্টে গেছে। ড. জিয়া রহমান বলছেন, যে স্বামী নিয়মিত নাইটক্লাবে যাচ্ছেন বা মদ সেবন করছেন বা বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক রাখছেন তার স্ত্রী বা সন্তানাদি বা পরিবারের অন্য কেউ বা আত্মীয়স্বজনরা সেটি পছন্দ করছেন না। এখানেই আস্তে আস্তে অপরাধের বীজ জন্ম নিচ্ছে। স্ত্রী বা সন্তানাদি এমন জীবনযাপনে অভ্যন্ত নন। তারা স্বাভাবিক কারণেই বাঁধার সৃষ্টি করছেন। তিনি বলছেন, অবশ্য যে পরিবারের সবাই এমন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত তাঁদের বিষয়টি ভিন্ন। তাঁরা ঠিক মানিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ওইসব পরিবারেও অশান্তি রয়েছে। তবে অশান্তির ধরন আলাদা। এসব পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরিবারের কোন সদস্য দামি গাড়ি কেনার জন্য বা দামি ফ্ল্যাটে আলাদা বসবাসের জন্য বা আলাদা বাড়িতে বসবাসের বায়না ধরছে। আর মেটাতে গিয়ে ঘটেছে চলেছে নানাধরনের অশান্তি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা নেই। নিম্ন আয়ের মানুষ খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত বা আর্থিক কারণে অনেকটাই বাধ্য বলা চলে। হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে হতাশা আর মাদকের কারণে নানাধরনের অপরাধ সংঘটিত করার প্রবণতা আছে। বাংলাদেশেরও অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারে পাশ্চাত্য ধাঁচের সংস্কৃতি প্রচলিত আছে। তবে পুরোপুরি নয়। পিতামাতার আলাদা বসবাস বা ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বা সন্তানাদির সঙ্গে আলাদা বসবাসের সংস্কৃতি এখনও বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এজন্য উচ্চবিত্ত অনেক পরিবারে এ ধরনের নানা অশান্তি বিরাজ করে। বিশেষ করে একাধিক দেশী বা বিদেশী মেয়ে বিয়ে করা, আলাদা সংসার করা, নাইটক্লাব বা হোমপার্টিতে যাতায়াতসহ নানাধরনের সংস্কৃতি প্রচলিত আছে। এজন্য উচ্চবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারের অনেকেরই বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কসহ নানাকারণে নানাধরনের পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে।
×