ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হিলিবন্দর দিয়ে বিনা শুল্কে চাল আমদানি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

হিলিবন্দর দিয়ে  বিনা শুল্কে চাল আমদানি

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ হিলিবন্দর দিয়ে বিনা শুল্কে চাল আমদানির সুযোগ থাকায় ভারতীয় চালে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। এতে করে ভরা মৌসুমে ধান ও চালের দাম পাচ্ছে না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তাই দিনাজপুরের চাতালগুলোয় অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে হাজার হাজার মেট্রিক টন চাল। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত জুলাই থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। এসব চালের কেজি প্রতি গড় আমদানি মূল্য ২৩ টাকা থেকে ২৮ টাকা ২২ পয়সা। আর আমাদের কৃষকদের একই ধরনের এক কেজি চাল উৎপাদনে খরচ পড়ছে ২৭ টাকা থেকে ৩১ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশে চাল উৎপাদন কম হওয়ায় বিগত জোট সরকারের আমলে আমদানি নির্ভরতা বাড়ে। সে সময় চাল আমদানিতে শুল্ক থাকলেও ওয়ান ইলেভেনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালের ঘাটতি মেটাতে চাল আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে। বর্তমানে দেশের চাল উৎপাদন চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত পর্যায়ে। কিন্তু বিনা শুল্কে তবুও চলছে চাল আমদানি। প্রতিদিন শুধু হিলিবন্দর দিয়ে আসছে প্রায় ৪শ’ মেট্রিক টন চাল। আমদানি করা চালের পাইকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় চালের গুণগত মান ভাল হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন চাল আমদানি বন্ধ না হলে কৃষক বাঁচবে না। চাল আমদানিকারক আলী হোসেন জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে বিনা শুল্কে চাল আমদানি চলছে। ইনভয়েস অনুযায়ী এ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে। তার দাবি, দেশের বাজারে ভারতীয় চালের চাহিদা থাকায় তারা চাল আমদানি করছেন। তিনি বলেন, ‘গড়ে প্রতিদিন হিলিবন্দর দিয়ে ৪শ‘ থেকে ৫শ’ মে টন চাল আমদানি করা হয়েছে। চালের দাম পড়েছে টন প্রতি ৩৬০ থেকে ৩৬২ ইউএস ডলার। আগে চাহিদা বেশি ছিল। দেশে আমনের উৎপাদন শুরু হওয়ায় এখন আমদানির পরিমাণ কমেছে। সে কারণে আমরা এলসিও খুলছি কম।’ এদিকে আমদানি করা চালের পাইকাররা বলছেন, ভারতীয় চালের গুণগত মান ভাল হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। হিলি বন্দরের পাইকার আলী হোসেন বলেন, ভারতীয় চাল ফ্রেশ এবং রান্না করার পর ভাত দীর্ঘসময় ভাল থাকে। একই সঙ্গে দেশী চালের থেকে মূল্য কম সে কারণে ভারতীয় চালের চাহিদা রয়েছে। এতে দেশীয় চালের ওপর প্রভাব পড়ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবেমাত্র মৌসুম শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। তাছাড়া বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানি চালের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে জানান তিনি। তবে পাইকারদের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন মিল মালিক ও কৃষকরা। কৃষকদের দাবি, পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন করেও তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দিনাজপুর সদর উপজেলার ৪নং শেখপুরা ইউনিয়নের গাবুরা গ্রামের কৃষক দৌলত তালুকদার জানান, তিনি ৫ বিঘা জমিতে ধান করেছিলেন। যা উৎপাদন হয়েছে তার সবই চাতালে দিয়েছেন। কিন্তু চাতালওয়ালারা টাকা দিচ্ছে না। তারা চাল বানিয়ে বিক্রি করতে না পারায় দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি। মিলাররা বলেছেন, চাল বিক্রি হলে টাকা দেবে। বাদশা মিয়া নামে অপর এক কৃষক জানান, ভাদ্র মাসে ধান চাতালে দিয়ে এখনও দাম পাননি। মিলাররা চাল বিক্রি করতে না পেরে গুদামে ফেলে রেখেছে। এখন আমন ধান নিয়েও বিপাকে রয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ইন্ডিয়া থেকে চাল আমদানির কারণেই এই অবস্থা। শহরের পুলহাট এলাকার মিল মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, ভারতীয় চাল আমদানির কারণে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা জানান, তাদের চালের পড়তা ২৮ টাকা, ভারতীয় চাল পাওয়া যাচ্ছে ২৮ থেকে ২৯ টাকায়! অনেক কর্মচারী নিয়ে তাদের ব্যবসা। এভাবে চলতে থাকলে তাদের চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তারা চাল আমদানিতে শুল্ক সংযোজনের দাবি করে বলেন, তাহলে ভারত থেকে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আসবে। এতে করে কৃষকরা যেমন ন্যায্য দাম পাবেন, তেমনি মিলাররাও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবে। এজন্য তারা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বীরগঞ্জ উপজেলার কবিরাজহাট এলাকার মেসার্স দুইভাই হাসকিং মিলের মালিক মাজেদুর রহমান বলেন, ‘আমন চাল সংগ্রহে সরকার কেজি প্রতি ৩২ টাকা দাম নির্ধারণ করেছে। এ অবস্থায় আমাদের এক কেজি চাল উৎপাদন করতে খরচ পড়েছে ৩০ থেকে ৩১ টাকা। আর ভারতীয় চাল আমদানি মূল্য ২৩ টাকা থেকে ২৮ টাকা ২২ পয়সা।’ এছাড়া বিনা শুল্কে চাল আসা অব্যাহত থাকলে অধিক মুনাফা লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ভারতীয় চাল সরকারী গুদামে ঢুকিয়ে দিতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। এজন্য তিনি অবিলম্বে চাল আমদানিতে শুল্ক বসানোর জোর দাবি জানান। অপরদিকে ভারতীয় চালের কারণে দেশীয় বাজারে বিরূপ প্রভাবের কথা স্বীকার করলেন আমদানিকারক সোহেল চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন চাল আমদানি করা মানেই কৃষকদের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি। চাষীরা চালের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। সরকারের উচিত দেশের কৃষক, চাতাল মালিক, মিলারদের রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। এসব বুঝেও কেন চাল আমদানি করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বোঝেন তো! ব্যবসা করি, দশ পয়সা যেখানে লাভ হবে সেদিকেই তো দৌড়াব!’
×