ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লা ও ডলার সঙ্কট রফতানি ও রেমিটেন্সে টান

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

কয়লা ও ডলার সঙ্কট রফতানি ও রেমিটেন্সে টান

ড. আরএম দেবনাথ ॥ কেউ কিছু বুঝলাম না, জানলাম না, হঠাৎ করে বাজারে ডলারের সঙ্কট। খোলা বাজারেও, সরকারী বাজারেও। ঋণপত্র (এলসি) খোলার ডলার নেই। এ এক আচমকা দুঃসংবাদ! এর ব্যাখ্যায় একটু পরে আসছি। প্রথমে আমাকে একটা কৈফিয়ত দিতে হবে। ভারতীয় ব্যাংকিংয়ের বর্তমান অবস্থা/পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে একটা সমস্যার কথা বলা হয়নি। আর সেটা মনে করিয়ে দিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি ব্রিকফিল্ডের ব্যবসা করেন। তাঁর কয়লা লাগে। তাঁর অভিযোগ, কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত থেকে কয়লা আসছে না। তিনি বরাবর ভারত থেকে কয়লা আনেন। বললাম এতে আমাদের করার কী আছে? তারা যদি কয়লা রফতানি না করে তাহলে তো জোর করে কয়লা আনা যাবে না। আনা যায় চোরাচালান করে। মুস্কিল হচ্ছে কয়লা এত ভারি ও এমনভাবে বস্তাভর্তি নয় ট্রাকভর্তি করে আনতে হবে যে তা লুকিয়ে আনা সম্ভব নয়। সমস্যার একটু ভেতরে ঢুকলাম, ঢুকে দেখি কয়লা এক মহাবিপদের জন্ম দিয়েছে উভয় দেশের ব্যাংকের জন্য। কিভাবে? ভারত সরকার কয়েকটি ব্লকে কয়লা বরাদ্দ দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ভারতীয় আদালত সরকারের ব্লক বরাদ্দের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। অতএব কয়লা সঙ্কট। তা হোক গে! কিন্তু মুস্কিল আছে। ভারতের কাছে ভারতের অর্থনীতিতে কয়লা অমূল্য সম্পদ। কয়লার একটা বড় জায়গা পশ্চিমবঙ্গের লাগুয়া অঞ্চল। এক সময় কয়লার মূল্য ঠিক করতে গিয়ে ভারত সরকার ‘ইক্যুয়েল প্রাইস’ নীতিনির্ধারণ করে। এতে পশ্চিমবঙ্গ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ‘সমমূল্য’ নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে কয়লার যে দাম পড়ে হাজার মাইল দূরে গুজরাটেও তাই পড়ে। এতে পশ্চিমবঙ্গ ‘কস্ট অব ট্রান্সপোর্টের’ যে সুবিধা পেয়ে কিছুটা লাভবান হতে পারত তা থেকে বঞ্চিত হয়। ‘বামেরা’ একে একটা বড় ইস্যু করে দল হিসেবে আস্তে আস্তে বড় হয়। যদিও অন্যান্য রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে এগিয়ে যায়। এহেন কয়লা এখন বাংলাদেশ ও ভারতের উভয়ের গলার কাঁটা হয়েছে। ভারতীয় ব্যাংকগুলো কয়লাতে নাকি প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বসে আছে। এখন কী হবে? রায় ভারতীয় কোর্টের। সরকার অসহায়। এর আগে সিমেন্ট কোম্পানি ‘লাফার্জের’ ক্ষেত্রেও এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটে। তখন বাজারে ‘লাফার্জের’ শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে। যাঁরা বুদ্ধিমান তাঁরা শেয়ার কেনে রাখেন। এখন ‘লাফর্জের’ আইনী নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছে। যাঁরা কম দামে শেয়ার রেখেছিলেন তাঁদের অনেকেই ‘লাল’ হয়েছেন। এখন কয়লা নিয়ে সমস্যা বাংলাদেশের ব্যাংকের। কিভাবে? ব্রিকফিল্ডে কয়লা লাগে, লাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ। এখন কয়লানির্ভর ব্রিকফিল্ডে কয়লা না পাওয়া গেলে ইট উৎপাদন বন্ধ। এতে অসুবিধা কী? কিছু অসুবিধা নেই যদি ব্রিকফিল্ডটি নিজের টাকায় মালিক করে থাকেন। মুস্কিল হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যবসা, মাঝারি ও বড় ব্যবসা নিজের টাকায় হয় না। ব্যাংকের টাকা ছাড়া ব্যবসা হয় না। আমার জানা মতে দুটো ব্যাংকেই কয়লা খাতে ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া আছে। সব ব্যাংক মিলিয়ে কত তা আমি জানি না। যত টাকা ঋণই হোক এই টাকার ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। ইট তৈরি না হলে, তা বিক্রি না হলে ব্যবসায়ী ব্যাংকের কিস্তি দেবেন কিভাবে? এর অর্থ ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাসিত (ক্লাসিফাইড) ঋণের পরিমাণ বাড়বে, বাড়বে এই মাসেই। এর জন্য কে দায়ী? ভারত সরকার, ভারতীয় আদালত, বাংলাদেশ সরকার, আমাদের দেশীয় ব্যাংক? দেখা যাক বিজ্ঞ অর্থনৈতিক রিপোর্টাররা কাকে দায়ী করেন? এখানে কথা একটা। ব্যবসা ছকে থেকে চলে না। কখন কী ঘটে, কিভাবে ঘটবে তা কেউ জানে না। কিন্তু তার ‘আছড়’ পড়ে ব্যাংকে। দেশে হয় হৈচৈ। গাল খায় ব্যাংকাররাÑ কখনও কারণে, কখনও অকারণে, তাই নয় কী? এবার আসা যাক ডলার ইস্যুতে। ডলার নিয়ে আমরা ভীষণ শান্তিতে ছিলাম। দিনের পর দিন ডলারে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ছেই। রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ। অন্য কথা বাদ দিলাম, একজন পর্যটক এখন প্রচুর ডলার নিয়ে বিদেশে যেতে পারেন। টাকা ও ডলারের মূল্যমানে আমরা যথেষ্ট স্থিতিশীল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবস্থান ভাল। পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায়ও ডলারের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অবস্থা ভাল। এসব ছিল সুখবর। ডলারে ডলারে সয়লাব ব্যাংকগুলো এ কথাই কাগজগুলো লিখেছে এতদিন। একই অবস্থা টাকারও। টাকায় টাকায় সয়লাব ব্যাংকগুলো। ডলার নেয়ার লোক নেই, ঋণ নেয়ার লোক নেই। ব্যবসায়ীরা বলছে মালে চাহিদা কম, তাই আমদানি কম, তাই ঋণপত্র কম, তাই ডলারের চাহিদা কমÑ কারণ ঋণপত্র খুলতে হয় ডলারে। এই অবস্থার মধ্যে হঠাৎ ডলার সঙ্কট কেন? হিসেবে কোন গ-গোল ছিল? ফান্ড ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দোষারোপ করে, ব্যাংকের প্রায় প্রতিটি ‘অডিট রিপোর্টে’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিটররা নিয়মিতভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমালোচনা করে, নির্দেশ দেয়, তাদের ‘রেটিং’ কমায় অথচ নিজেদের ‘ফান্ড ম্যানেজমেন্ট’ই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। মনে হয় গবর্নর সাহেবকে ‘রোজিপিকচার’ দিয়ে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করা হয়। নতুবা বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হলো কেন? কারণ কতগুলো আছে। যেমন ‘ডেফার্ড এলসি’ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মিতভাবে বিলম্বিত পরিশোধের ভিত্তিতে খোলে। এগুলোর পরিশোধের সময়সীমা আছে। এর হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকার কথা। হঠাৎ করে কী বড় বড় পরিমাণের ‘ডেফার্ড এলসি’ পেমেন্টের সময় এখন? এ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। যদিও এটি বর্তমান ডলার সঙ্কটের একটা কারণ হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক বড় বড় কোম্পানিকে বিদেশে ডলারে ঋণ করতে অনুমতি দিয়েছে। এসব কোম্পানির ওই ঋণ পরিশোধের জন্য ‘ডলার ফান্ড’ বিল্ড আপ করার কথা। করতে পারুক আর না পারুক ডলার পেমেন্ট নিয়মিতভাবে করতেই হবে। নতুবা বাংলাদেশ ‘ডিফলটার’ দেশে পরিণত হবে। এই সূত্র থেকে কি বর্তমান ডলার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় কোম্পানির ঋণের আসল ও কিস্তি পরিশোধের ‘ডিউ ডেট’ ডায়েরি থাকার কথা। এখানে কি কোন মিসমেস হয়েছে। আবার সরকারের নিজস্ব বিদেশী ঋণও আছে। সেসবের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হয়। সেই হিসাবও আছে। এ সমন্বয় করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগও আছে। সেখানে কি কোন গ-গোল হয়েছে। আবার আছে ‘আকু’ পেমেন্ট। এটা ‘এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের’ পেমেন্ট। এটা সাময়িক। কয়দিন বাদে বাদে নিয়মিতভাবে এর টাকা শোধ করতে হয়। এটা অনেকটা সিস্টেমের মধ্যেই আছে। এখান থেকে সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। আবার হতে পারে হঠাৎ আমদানি এলসি বেড়ে গেছে। আমদানি এলসি হতে পারে সরকারের, হতে পারে বেসরকারী খাতের। একটি খবরে দেখলাম এলসি বেড়েছে। তবে বেসরকারী খাতের এলসির চেয়ে মনে হচ্ছে সরকারের বড় বড় এলসি বেশি হচ্ছে। সরকারের বড় বড় এলসির মধ্যে আছে পেট্রোলিয়াম আমদানির এলসি, সারের এলসি অথবা খাদ্যের এলসি। এই মুহূর্তে পেট্রোলিয়ামের এলসিই হওয়ার কথা। অথবা ‘ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের’ ঋণের টাকা পরিশোধের সময়ও হতে পারে। এটা হলে এখানে বড় অঙ্কের টাকা। কিন্তু তা তো হিসাবের টাকা। পরিকল্পিত পেমেন্টের মধ্যে থাকার কথা। অতএব এই উৎস থেকে ডলার সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। তবে যেই আলোচনাই করি না কেন আসল কথা হচ্ছে ডলারের আমদানি। বিদেশ থেকে যদি নিয়মিতভাবে ডলার হিসাব মতো না আসে তাহলেই সমস্যা। ডলারে খরচা তো ঠিকই আছে। এখন আমদানির জন্য ডলার আসবে কোত্থেকে? দুই উৎস আমাদের প্রধান উৎস। এক উৎস হচ্ছে রফতানি এবং অন্য উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। যা আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে দুটোতেই টান পড়েছে। রফতানি আয়ে একটা ভাটা পড়েছে। হতে পারে এটা সাময়িক। আবার তা কিছুদিন স্থায়ীও হতে পারে। পশ্চিমা বাজারে মন্দা চলছে। আমেরিকায় মন্দা চলছে। যদি তাদের মন্দা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে আমাদের তৈরি পোশাক রফতানি বিঘিœত হতে পারে। শত হোক আমাদের হচ্ছে এক ‘পোলার সংসার’। গ্রামের লোকেরা আগে বলত এক ‘পোলার’ বিশ্বাস নেই। আমাদের এক ‘পোলা’ মানে তৈরি পোশাক। এই একটা মাত্র পণ্যের ওপর আমাদের রফতানি নির্ভরশীল। অতএব এর মধ্যে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে বিপদ। সরকারের এই ক্ষেত্রে সাবধান হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত রেমিটেন্স। রেমিটেন্সও আগের মতো আসছে না। অনেক সময় রেমিটেন্স এক-দুই মাস খুব বেশি আসে। যেমন ঈদ-পার্বণে। পরে রেমিটেন্স কমে। আবার বিশ্ববাজারে রেমিটেন্সের মন্দাও চলছে। কিছুটা ক্ষতিপূরণ করতে পারত ঋণ ও সাহায্য। ঋণ ও সাহায্য আগের মতো চাইলেই পাওয়া যায় না। পরিশেষে বলা দরকার একটা কথা। আত্মসন্তুষ্টি ভাল, কিন্তু সব সময় ভাল নয়। ডলার রিজার্ভ বেশি দেখে অনেকের অহঙ্কারী ভাব হয়। এই ‘ভাব’ থেকে মুক্ত থাকা দরকার। ডলারে ভেসে ভেসে থেকে ভারত একবার হঠাৎ ভীষণ ডলার সঙ্কটে পড়ে। এটা বেশিদিন আগের কথা নয়। এখনও কিছুটা শান্তি আছে। এখনও মনে হয় ডলার সঙ্কট নিয়ন্ত্রণাধীন। এসবই আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসের দাম কম থাকার কারণে। বাজার একটু চাঙ্গা হলেই কিন্তু অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করবে। অতএব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে সদা সতর্ক থাকা। আশা করি গবর্নর ড. আতিউর রহমান এ ব্যাপারে সজাগ আছেন। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×