ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সেলিম

বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু

(১ ডিসেম্বরের পর) বিগত শতাব্দীর পাকিস্তানী ঘাতক সেনাবাহিনীর পরিচালিত ভয়াবহ গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এবং প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফলশ্রুতি ও একটি চরম অসুবিধাজনক ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, সম্পূর্ণ শূন্য হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক পুনর্গঠন করে দেশকে যখন উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ’৭১-এর ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত দুশমন, দালাল, ষড়যন্ত্রকারী পাক-মার্কিন মদদপ্রাপ্ত ঘাতক চক্র, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, মার্শাল টিটোর বন্ধু ও বিশ্বের নির্যাতিত, শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট গোটা পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রয়াত এই দুই সংগ্রামী মহান জনপ্রিয় নেতার দেশ পরিচালনা ও দেশাত্মবোধক নেতৃত্বের একটি অভিন্ন ও সফল বাস্তব উদ্দেশ্য ছিল নিজ নিজ দেশের জনগণকে সুখী ও দেশকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলা। জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্থিতিশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আঞ্চলিক সহাবস্থান নীতিকে আরও গভীরতর এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করা মার্শাল টিটো যেমনি তাঁর শক্তিশালী নেতৃত্বের দ্বারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর হতেই যুগোসøাভ রাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় নীতি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করেছিলেন, তেমনি স্বাধীন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শূন্যহস্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রভার গ্রহণ করে দেশকে পুনর্গঠন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে ও তার জনগণকে বিশ্বের নিকট পরিচিত করে গেছেন। ১৯৮০ সালের ৪ মে, যুগোসøাভিয়ার এই জাতীয় বীর জনপ্রিয় নেতার অকাল মৃত্যুতে গোটা বলকান অঞ্চলের জনগণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় অভিভাবক নেতাকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এক শোকসাগরে পরিণত হয়েছিলেন। একদা সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা সার্ব ও ক্রোয়েশিয়ানদের মধ্যে ওই দিন অনুষ্ঠিত ফুটবল খেলার অংশগ্রহণকারী দুই সম্প্রদায় ও জাতীয় খেলোয়াড়বৃন্দ তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার অকাল মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে খেলা বন্ধ রেখে তাদের বীর রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। মার্শাল টিটো ছিলেন আধুনিক যুগোসøাভিয়ার জনক ও শ্রষ্টা, যে নেতার কথা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, বৈরীভাবাপন্ন জাতীয় বিভিন্ন গ্রুপ ও দলকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি দৃঢ়বদ্ধ স্থায়ী শক্তিশালী দেশের নাগরিক হিসেবে সকলকে একই সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন। বহির্বিশ্বে সম্মানিত যুগোসøাভ নেতার রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সেদিন প্রায় ১২২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান অথবা তাঁদের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর যুগোসøাভ রিপাবলিক অধীনস্থ ছয়টি প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায় ও দল, তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিশেষ করে বসনিয়া হার্জেগোবিনিয়া ও কসোভোর আলবেনিয়ান বনাম সার্বিয়ানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত উত্তেজনা দানা বেঁধে ওঠে। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর প্রথমে ভ্যাসেলিন ডুরানভিক ক্ষমতা গ্রহণের পর যুগোসøাভিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের কর্মসূচীর অন্যতম মুদ্রার অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করলে ক্ষমতাসীন সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নীতির অমিল হওয়া রাষ্ট্র পরিচালনায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। যদিও মার্শাল টিটোর জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে টিটো সম্মত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর যুগোসøাভিয়া অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ায় ‘যুগোসøাভিয়ার বন্ধু’ নামক একটি মার্কিন সংগঠনের প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুগোসøাভিয়ার সম্পর্কের উন্নয়ন হয় ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দেউলিয়াত্বের লাঘব ঘটে। তারপরও যুগোসøাভিয়ার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ফেডারেল কাঠামো ব্যবস্থা ভেঙ্গে বিভক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী মার্কোভিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে খোলা ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে শুরু করলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ফেডারে যুগোসøাভিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে জাতি ও সম্প্রদায়গত দাবি দাওয়া সংবলিত আন্দোলন শুরু হওয়ায় শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে প্রধানমন্ত্রী মার্কোভিকের অর্থনীতি সংস্কার কর্মসূচী অসমাপ্ত থাকে। ইতোমধ্যে বেলগ্রেডে নবনিযুক্ত ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সেøাভদান মিলোসেভিক কঠোর হস্তে কসোভো ও মন্টিনিগ্রোতে চলমান স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দমন করতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে মার্শাল টিটোর শাসনামলে প্রদত্ত কসোভোর স্বায়ত্তশাসন অধিকার বাতিল ও ছিনিয়ে নেয়ায় কসোভোতে প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। বেলগ্রেডের নব্য শাসক মিলোসেভিকের কিছু হঠকারী গণবিরোধী সিদ্ধান্ত মার্শাল টিটোর ফেডারেল যুগোসøাভ শাসন ব্যবস্থা ভাঙ্গনের পথকে প্রসারিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল ক্লিনটন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ ও সমর্থনে প্রচারিত প্রোপাগান্ডা, কসোভো ও অপর প্রদেশের আন্দোলন, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং কসোভোর আলবেনিয়ানদের ওপর সার্বিয়ান মিলেসেভিক বাহিনীর নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে পশ্চিম ইউরোপের ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ন্যাটোর বিমান হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ অপর কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশ যুগোসøাভ প্রজাতন্ত্রকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করার দীর্ঘদিনের বিশেষ পরিকল্পনা ও প্রোপাগান্ডা মিথ্যা প্রচারণায় সরাসরি জড়িত হয়ে তাদের দীর্ঘদিনের ঐকান্তিক মতলবকে চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করে। মার্শাল টিটোর জীবিতাবস্থায়ই বলকান অঞ্চলে ও পূর্ব ইউরোপের কিছু কিছু দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনুপ্রেবশ করে ওই দেশগুলোতে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি আদর্শের কালো থাবাকে প্রসারিত করে ওই সকল অঞ্চল ও দেশে গোপন অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগ বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট যুগোসøাভ প্রজাতন্ত্রের বিখ-িত করার বিশেষ দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেছিল। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যুগোসøাভিয়ার অভ্যন্তরে দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে নিরবচ্ছিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা ছাড়াও কয়েকজন মার্কিন তদানীন্তন উল্লেখযোগ্য কংগ্রেস ও সিনেট সদস্য যেমনÑ জো বাইডেন, রবার্ট ডোল এবং জন মিচেল বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়, ক্রোয়াট ও কসোভোর আলবেনিয়ানদের পক্ষে ও যুগোসøাভ প্রজাতন্ত্র তথা বেলগ্রেডের শাসকদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়ে গোটা যুগোসøাভ প্রজাতন্ত্রের প্রদেশগুলোর জনসাধারণের মধ্যে এক ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তোলে। মার্কিন তদানীন্তন ওই সকল কংগ্রেস ও পররাষ্ট্র বিভাগের সৃষ্ট ও পরিকল্পিত বিদ্বেষমূলক প্রচারণার দায়িত্ব যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছিল কুখ্যাত কয়েকটি মার্কিন প্রোপাগান্ডা ফার্ম বা কোম্পানি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল হিল এ্যান্ড নলঠন। এই প্রোপাগান্ডা ফার্মের বিকৃত ও গণধিকৃত সার্বিয়ান বেলগ্রেডবিরোধী শক্তিশালী প্রচারণা, বসনিয়া ও কসোভোর স্বায়ত্তশাসন দাবির আন্দোলনের বিরুদ্ধে সার্বিয়ার শাসক, মিলোসভিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন ও নৃশংসতার ঘটনাবলীর ওপর বিরামহীনভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ এবং কূটনীতিকগণ ভালমন্দ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই না করেই গলদে ধারণ করে নিয়েছিলেন। মার্কিন এই সকল কুখ্যাত প্রচারণা এ্যাজেন্টগুলো ১৯৯১ সালে কুয়েত সরকারের পক্ষ হয়ে ইরাকের লৌহমানব এক নায়ক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে হরেক রকম প্রচারণা চালিয়ে ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযান শুরু করার পূর্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। যার ফলস্বরূপ কুয়েতে সাদ্দাম হোসেনের রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীর দ্বারা কয়েতে নৃশংসতার অনেক ভুয়া ও কাল্পনিক কাহিনী বাস্তব হিসেবে বহির্বিশ্বে সাদ্দামবিরোধী শক্তিশালী প্রচারণার মিশন বাস্তবায়ন করেছিল। (চলবে)
×