ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আমরা বিজয়ের কিছু অর্জন অন্তত রক্ষা করেছি

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

আমরা বিজয়ের কিছু অর্জন অন্তত রক্ষা করেছি

বাংলাদেশের বিজয়ের মাসে স্বাধীনতার যুদ্ধে আমাদের বিজয় নিয়ে কিছু একটা লিখব ভাবছিলাম। আমার প্রয়াত বন্ধু এমআর আখতার মুকুল মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ছিলেন এই যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি একটা বিখ্যাত বই লিখে গেছেন, নাম : ‘আমি বিজয় দেখেছি।’ আমি নিজেও একাত্তরের একজন কলম যোদ্ধা ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় আমিও দেখেছি। তারপর দেখেছি সে বিজয় কেমন করে ছিনতাই হয়ে গেল। তার পরের ইতিহাসও আমার জানা। সেই অপহৃত বিজয় পুনরুদ্ধারের জন্য দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের সে কি অবিরাম সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম এখনও অব্যাহত। এরই মাঝে দেখতে দেখতে বিজয় অর্জনের তেতাল্লিশটি বছর কেটে গেছে। তেতাল্লিশ বছরে এই বিজয়ের অর্জন ও বিসর্জন, পতন এবং উত্থানের একটা পটভূমি স্মরণে রেখে দেশের অবস্থার দিকে তাকালে কি মনে হবে, আমরা বিজয়ের সব অর্জনই হারিয়েছি, না কিছু অর্জন এখনও ধরে রেখেছি? এ নিয়ে গত কিছুদিন যাবত ঢাকার কয়েক সাংবাদিক ও কলামিস্ট বন্ধুর সঙ্গে আলাপও করেছি। তাঁদের মধ্যে একজন, নাম প্রকাশের অনুমতি নেইনি বলে নাম দিতে পারলাম না, একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অর্জন সবটা হারায়নি। কিছুটা এখনও ধরে রেখেছে।’ তাঁর মুখে এ কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। কিছুদিন আগে, অর্থাৎ চলতি সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগেও তার সঙ্গে কথা বলে দেশ এবং সরকার সম্পর্কে ক্ষোভ ও হতাশামূলক কথা শুনেছি। তিনি রাজনৈতিক বিশ্বাসে বাম ঘেঁষা। বর্তমানে দেশ ও হাসিনা সরকার সম্পর্কে অধিকাংশ বামের একটা নেতিবাচক মনোভাব আছে। এই সাংবাদিক বন্ধুর কথা এতদিন শুনেও ভেবেছি, এটা সেই বামসুলভ নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। কিন্তু হালে এই বন্ধুসহ আরও কয়েক সাংবাদিক বন্ধুর কথাবার্তা শুনে তাঁদের এই মনোভাব পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছি। এই একজন বন্ধুর কথাই বলি। ৫ জানুয়ারির আগেও তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে প্রায়ই কথাবার্তা হতো। তিনি অধিকাংশ সময় দেশ এবং হাসিনা সরকার সম্পর্কে একটা হতাশামূলক মনোভাব ব্যক্ত করতেন। এই সেদিন দেখলাম, তিনি সম্পূর্ণ অন্য সুরে কথা বলছেন। বললেন, দেশটা মোটামুটি ভালই চলছে গাফ্্ফার ভাই। চার পাশের অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ভালই আছে মনে হয়। মানুষ এই সরকারকে মেনে নিয়েছে। শুধু মেনে নেয়নি; এই সরকার সম্পর্কে তাদের আগের অসন্তোষ তেমন নেই। জিজ্ঞেস করেছি, এটা কি করে ভাবলেন? আগে তো বলতেন, মানুষ এ সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। সাংবাদিক বন্ধু বললেন, আমি নিজের কথা নয়, দেশের মানুষের কথাই বলেছি। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের জন্য আমি অনেক সময় নিজের গাড়ি রেখে রিক্সায় বা বাসে অফিসে যাই। তখন রিক্সাচালক, বাস ড্রাইভারদের কথা শুনি। আগে দেখেছি, তারা সরকারের ওপর মহাত্যক্ত-বিরক্ত। এখন দেখছি, তাদের সেই অসন্তোষ ও বিরক্তির ভাব তেমন নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এত যে তর্ক-বিতর্ক তাতেও তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের মধ্যে একটা সন্তোষের ভাব। যখন তাদের মধ্যে এই মনোভাব ছিল না, তখনও সে কথা আপনাকে জানিয়েছি। এখন যে তাদের মনোভাব পাল্টে গেছে, সে কথাও আপনাকে জানাচ্ছি। এখানে আপনাকে বলতে আপত্তি নেই, দেশ ও সরকার সম্পর্কে আমার মনোভাবও পাল্টেছে। এর কারণ জানতে চাইলে এই সাংবাদিক বন্ধু আমাকে যা বললেন, তা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। তিনি আমার চাইতে বয়সে অনেক ছোট। বাম ঘরানার সাংবাদিক। থাকেন দেশে। তাঁর মতামতকে আমি গুরুত্ব দেই। সেদিন তাঁর কথা শুনে মনে হলো, আমরা গত তেতাল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সব অর্জন হারাইনি। কিছু উদ্ধার, কিছু ধরে রাখতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু এবং হিংস্র মৌলবাদের উত্থান আমরা কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে দিতে পেরেছি। তার কৃতিত্ব বাম তাত্ত্বিকদের নয়। একটা সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী সুশীল সমাজের নয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও নোবেলজয়ী মনীষীর নয়; নিরপেক্ষতার ভেকধারী কোন মিডিয়ার নয়। এই কৃতিত্ব একজন সাধারণ গৃহবধূর। যিনি অসম্ভব ঝড়ঝঞ্ঝার সময়ে সাহস করে এসে দেশের অস্থির রাজনীতির হাল ধরেছিলেন। অনেক ভুলভ্রান্তি, পতন, উত্থানের মধ্যেও হালটি এখনও ধরে আছেন। বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার এখন প্রতিবেশী ভারতের চাইতেও নিয়ন্ত্রিত। দ্রব্যমূল্যে যে স্থিতিশীলতা, গত তেতাল্লিশ বছরে তা কখনও ছিল না। ভারতে এখনও সার, ভর্তুকি, কৃষি ঋণের অভাবে কোন কোন রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশের কৃষক মোটামুটি সম্পন্ন। ইংরেজ আমলের সূচনা থেকে যে দেশ ছিল দুর্ভিক্ষের দেশ নামে পরিচিত, যে দেশকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বছরে ১৭ থেকে ২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হতো, সে দেশ এখন ১৫ কোটি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করে প্রতি বছর চাল বিদেশে রফতানি করছে। আর এটা সফল হয়েছে হাসিনা সরকারের আমলেই। এটা কি কম সাফল্যের কথা! ইতালির এক মন্ত্রী বাংলাদেশের এক সরকারী কর্মকর্তাকে বলেছেন, তোমাদের চাইতে আমাদের জনসংখ্যা অনেক কম। সেখানে এই কম জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা আমরা মেটাতে পারছি না, তোমরা ১৫ কোটি মানুষের সেই চাহিদা কি করে পূরণ করছ, তা ভেবে আমরা আশ্চর্য হই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে নোবেল জয়ী ড. অমর্ত্য সেনও প্রশংসা করেছেন। দেশের মানুষ এখন আগের চাইতে অনেক বেশি শান্তিতে ঘুমাতে পারে। গ্রামাঞ্চলেও অপরাধের সংখ্যা কমেছে। ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় নেই সেখানে। একজন সক্ষম মজুর দিনে চার শ’ থেকে সাত শ’ টাকা উপার্জন করতে পারে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে দেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় চেহারা পাল্টে যাবে। বিশ্বব্যাংকও প্রচ- চাপ দিয়েও হাসিনা সরকারের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের রাজনীতি হালে পানি পাচ্ছে না। তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানে হাসিনা সরকার অটল রয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি এবং হাসিনা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস ও সুশীল সমাজের তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকার সম্পর্কে আমেরিকা ও ইউরোপের বিরোধিতা ক্রমশই কমছে। ভারতে সরকার পরিবর্তন সত্ত্বে¡ও ঢাকা-দিল্লীর সম্পর্ক আগের চাইতে অনেক বেশি শক্ত। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ বিষয়ের মতো বিদেশ নীতির ক্ষেত্রেও হাসিনা সরকারের সাফল্য এখন অনেক বেশি। দেশের মানুষ তাই এ সরকার সম্পর্কে অখুশি নয়। পেটে ভাত থাকলে আর শান্তিতে দিন কাটাতে পারলে কেইবা সরকারের ওপর অখুশি হয়? সরকার সম্পর্কে জনগণের এই সন্তুষ্টির ফলে বিএনপির হাঁকডাক, আন্দোলনের ডাক মাঠে মারা যাচ্ছে। জামায়াতও তাদের নখরদন্ত বের করার সাহস পাচ্ছে না। বিদেশী এক পর্যবেক্ষকের মতে, হাসিনা সরকারের বড় সাফল্য উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাস দমন। পাকিস্তানে যেখানে আমেরিকাকে ডেকে এনে অব্যাহত ড্রোন হামলা চালিয়েও মৌলবাদী জঙ্গীদের দমন করা যাচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশে নিজস্ব প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তির সাহায্যে জঙ্গী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনা কম কৃতিত্বের কথা নয়। এই সরকারের ব্যর্থতা, আপোস, পদস্খলনের উদাহরণ অনেক। কিন্তু বিশ্বের কোন্্ গণতান্ত্রিক সরকারের তা নেই? যে অসম্ভব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের একজন সাধারণ গৃহবধূ রাজনীতিতে এসে আর কিছু না পারুন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিভু নিভু মশালটিকে জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছেন এবং এখনও জ্বালিয়ে রেখেছেন, তা এক অসাধারণ কৃতিত্ব। এই কৃতিত্বের জন্যই ইতিহাসে শেখ হাসিনা স্থায়ী আসন পাবেন। আমার এই সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশের অবস্থার এই ইতিবাচক দিক, সরকারের এই চতুর্মুখী সাফল্য সত্ত্বেও আমাদের সুশীল সমাজের বড় বড় প-িত এবং দু’-একটি বিগ মিডিয়া এই সরকারের ওপর এত চটা কেন? কারণে-অকারণে তাদের এত সরকারবিরোধী প্রচারণা কেন? বন্ধু হেসে বলেছেন, আপনাকে সত্যি কথা বলব? কারণ আর কিছু নয়, ঈর্ষা। এতসব আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত ও স্বীকৃত প-িত এবং মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদক দেশে থাকতে তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না; তাঁদের কথা কেউ শুনছে না; একজন গৃহবধূ সাধারণ মন্ত্রী-আমলা নিয়ে সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছেন; তাদের পাত্তা দিচ্ছেন না, এটা এই এলিট ক্লাস ও তাদের নিয়ন্ত্রিত একশ্রেণীর মিডিয়ার সহ্য হচ্ছে না। ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস বা তাঁদের পেটোয়া দুটি মিডিয়ার সঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বা তাঁর মতো ব্যক্তিদের রাজনৈতিক মতের গরমিল থাকতে পারে; কিন্তু হাসিনা ও আওয়ামী-বিদ্বেষের ব্যাপারে কোন অমিল নেই। আমি এই বিজয়ের মাসে ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে এই ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করেছি। এই সরকারের যারা দারুণ ক্রিটিক, তাদের অনেকেও এখন স্বীকার করেন, অনেক সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যেও এই সরকারের বড় সাফল্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অর্জনগুলো, যা স্বাধীনতার শত্রুদের দ্বারা ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছিল, এই সরকার তার অনেকগুলোই রক্ষা করেছেন এবং শুধু রক্ষা করা নয়, অর্জনগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। আমরা যারা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, সেই বিজয়ের অর্জনগুলো ধ্বংস হয়নি, বরং পুনর্প্রতিষ্ঠ হতে চলেছে, এটা দেখে যাওয়াই আমাদের জীবনের সবচাইতে বড় সান্ত¡না। দানবের মূঢ় অপব্যয় থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো অন্তত রক্ষা পেয়েছে, এটাই সব ব্যর্থতার মধ্যে জাতিকে সাহস যোগাবে। [লন্ডন ২ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৪ ॥
×