ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকার দিনরাত

ডিসেম্বর এসে গেল তবে! ডিসেম্বর আসার আগেই বিজয় দিবসের কথা মনে পড়িয়ে দিলেন ওই পতাকা বিক্রেতা। খালি পা, মলিন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। পতাকা বিক্রির মৌসুম দুটিÑ একেবারে বাঁধাধরা। মার্চ এবং ডিসেম্বর। বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা যে হারে বিক্রি হয় সে তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এই দুটি মাসে কমই বিকিকিনি হতে দেখি। আসলে তুলনাটা করা ঠিক হলো না। একটি হচ্ছে বছর চারেক পরে হুজুগে মাতা, এক অন্ধ উন্মাদনা; অপরটি বুকের গভীরে লালন করা এক চিরকালীন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো আত্মগৌরব। তাতে দেখানেপনা নেই। যদিও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বেলায় ভিন্ন হিসাব কাজ করে। সেখানে প্রকাশিত হয় দেশের প্রতি দরদ ও গৌরব। বাংলাদেশ দল হঠাৎ হঠাৎ জয়ের স্বাদ পেলে ঢাকায় আনন্দের ঝড় বয়ে যায় হাজার মাইল বেগে! শুধু কি ঢাকায়? গোটা দেশই তখন এক আনন্দ-পারাবার। তখন ঢাকার রাস্তায় এমন পতাকা বিক্রেতার দেখা মেলে। নিশ্চয়ই এদের আসল পেশা ভিন্ন। বহু বছর আগে বিটিভির বিজয় দিবসের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এমন ক’জন পতাকা বিক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। জেনেছিলাম কেউ ক্ষেতমজুর, কেউ রিকশাওয়ালা, কেউ বা মনোহর দ্রব্যের ফেরিওয়ালা। উত্তরা মডেল টাউনের নর্থ টাওয়ারের দীর্ঘ ছায়ার নিচে দাঁড়ানো আমাদের এ খণ্ডকালীন পতাকা বিক্রেতাটির মাথার গামছায় ডমিনেট করছে সবুজ রং, খুব লক্ষ্য করে দেখলে লাল স্ট্রাইপ নজরে পড়ে। কাঁধে ঠেস দেয়া দেড়তলা সমান দণ্ডে বিভিন্ন মাপের জাতীয় পতাকা আঁটকানো। উত্তুরে হাল্কা হাওয়ায় উড়ছে পতপত লাল-সবুজের অহঙ্কার। আহা আমার প্রাণের পতাকা। এটি অর্জনের জন্যে আমাদের আপনজনদের রক্তগঙ্গায় স্নাত হয়ে উঠেছিল বাংলার মাটি। এর গৌরব রক্ষা করতে গিয়ে বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের কতই না সংগ্রাম আর সাধনা। হায়েনা হটিয়ে হটিয়ে আশ্চর্য রক্তগোলাপকে চিরঞ্জীব রাখা। বছরের শেষতম এ মাসটি ফি বছর এসে উপস্থিত হয় আনন্দ-বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল এ মাসটিতে, অর্জিত হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয়। ষোলোই ডিসেম্বরে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী বাধ্য হয়েছিল অস্ত্র সমর্পণ করতে। কিন্তু তার অব্যবহিত আগে তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় তারা ইতিহাসের বর্বরতম মানব-নিধনে মেতেছিল। চৌদ্দই ডিসেম্বরে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার শত্রুরা আমাদের মেধা ও মননশীলতার সঙ্কটে নিমজ্জিত করতে চেয়েছিল। ডিসেম্বর ফিরে এলে তাই আমাদের এক চোখে অশ্রু টলমল করে। অন্য চোখে খেলে যায় খুশির ঝিলিক। আরেক রাজাকার কমান্ডার ধরাশায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আরও এক রাজাকার কমান্ডার মোবারকের ফাঁসির রায় পাওয়া গেল ২৪ নবেম্বর। মিলল জাতির আরেকটি পরম স্বস্তি ও তৃপ্তির উপলক্ষ। বিজয়ী পক্ষ কিংবা জিতে যাওয়া ব্যক্তির দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে ভি চিহ্ন দেখানোটা রীতিসিদ্ধ। যেমন রায় ঘোষণার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘বিচ্ছু জালাল’ বিজয়সূচক চিহ্নটি প্রদর্শন করেন যা ছাপা হয় জনকণ্ঠের প্রথম পাতায়। কিন্তু অবাক কাণ্ড হলো, ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মোবারকও আদালতের বাইরে উপস্থিত ফটো-সাংবাদিকদের ভি চিহ্ন দেখান। এর অর্থ বোধগম্য নয়। তার এই কাণ্ড দেখে অনেকেরই মনে পড়ে যাবে গত বছর দণ্ডিত কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন প্রদর্শনের স্মৃতিটি। তখন অবশ্য তার ফাঁসির রায় হয়নি। সেটা ওই খুনীর জন্যে বিজয়ের সমতুল্যই ছিল। এরপর হলো ইতিহাস! স্বল্পতম সময়ের ভেতর জ্বলে ওঠে শাহবাগ। জন্ম নিল গণজাগরণ মঞ্চ। চলতে থাকল লাগাতার বিক্ষোভ। গোটা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সব মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠল শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। আর শেষ রক্ষা হলো না কাদের মোল্লার। সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতে হবে, পরে বিতর্কের জন্ম দেয় গণজাগরণ মঞ্চ। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন বহু মানুষের মনে হতাশা জন্ম নেয়। মোবারকের ফাঁসির রায় শুনে শাহবাগে আনন্দ মিছিল বের করে গণজাগরণ মঞ্চ। নারী নির্যাতনবিরোধী দিবসে সাহিত্যে জীবনের গভীর উপলব্ধি ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা উঠে আসে তাৎপর্যপূর্ণভাবে, যদি তেমন সাহিত্য হয়। ২৫ নবেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতনবিরোধী দিবসে নারী লেখকদের সংগঠন ‘গাঁথা’-র আয়োজনটি ছিল ভিন্নধর্মী। নারীর প্রতি নির্যাতন এবং নারী কর্তৃক সেই নির্যাতন প্রতিরোধÑ উভয় দিক নিয়ে রচিত সাহিত্য পঠিত ও আলোচিত হয় ওই অনুষ্ঠানে। ধানম-ির ইএমকে সেন্টারের দশম তলায় আক্ষরিক অর্থেই বসেছিল নারী লেখকদের মেলা। এসেছিলেন সেলিনা হোসেন, মালেকা বেগম, নিয়াজ জামান, নাসরীন জাহানসহ অনেকেই। গল্পকার ঝর্ণা রহমান গল্প-কবিতা লেখেন আবার সঙ্গীত পরিবেশনও করে থাকেন। তাঁর সঙ্গে মনিকা চক্রবর্তী, জ্যাকি কবিরসহ গাঁথার কয়েকজন সদস্য সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সংকোচের বিহ্বলতায় নিজেরে অপমান’। ‘মুক্ত কর ভয়; আপনা মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়’Ñ এমন স্পষ্ট প্রেরণা রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই গানে। এর পরই মালেকা বেগম বাংলাদেশের নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশদ বক্তব্য তুলে ধরলেন। নিজের লেখা গল্পে নারীর অবমানিত অবস্থান ও সংগ্রামের চিত্র কিভাবে এসেছে তা নিয়ে স্বকীয় ভঙ্গিতে প্রাঞ্জলভাবে বলে গেলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। নিজ লেখা নিয়ে লেখক আলোচনা করলে পাঠকের কাছে সেই রচনার অনেক গুপ্ত সঙ্কেত ও প্রচ্ছন্ন বক্তব্য স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। স্বাধীন দেশে বঞ্চিতলাঞ্ছিত একজন বীরাঙ্গনার জীবনকথা নিয়ে লেখা শাহীন আকতারের উপন্যাস ‘তালাশ’ বেশ আলোচিত ও পুরস্কৃত। উপন্যাসটি থেকে খানিকটা করে উদ্ধৃতি দিলেন লেখক। ঝর্ণা রহমান, পাপড়ি রহমান ও আনোয়ারা আজাদ নিজেদের লেখা গল্প পড়লেন; কবিতা পড়েন জুনান নাশিত ও আয়েশা ঝর্ণা। সব মিলিয়ে বিশেষ দিবসের বিশেষ আলোকপাত। এ অনুষ্ঠানে দর্শকসারিতে অল্প ক’জন পুরুষ ছিলেন। পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রই নারী নির্যাতনের নেপথ্য খলনায়ক। তাই এমন আয়োজনে পুরুষের অধিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার। অঘ্রানে উৎসবের ঘ্রাণে ২২ নবেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় অফিস শেষে এক কবিবন্ধুর সঙ্গে সোজা চলে গেলাম রমনা উদ্যানে। সেখানে চলছে তিন দিনব্যাপী ‘কৃষি নবান্ন উৎসব’। ব্যস্ত রাজধানীর ফুসফুসসম যে ক’টি পার্ক এখনও নগরবাসীর জন্যে স্বস্তিদায়ক তার ভেতর রমনা পার্ক অন্যতম। প্রতিদিন ভোরবেলা স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন; অনেকে হাল্কা ব্যায়াম সেরে নেন। বৃক্ষের সমারোহ আর পাখপাখালির ডাক নাগরিক মনকে ক্ষণিকের জন্য হলেও উদাস করে তোলে। গভীর প্রশান্তি দেয়। উদ্যানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কানে আসে সেই বিখ্যাত লোকগানÑ বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে/ কী জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে। একটি গানই কেমন করে যেন এক টানে আমাদের মনে স্ফূর্তি জাগিয়ে তোলে। বেশ বড়সড় একটি মঞ্চে এক অচেনা শিল্পী গানটি গেয়ে চলেছেন। খুবই আন্তরিক তার গায়কী। দর্শকশ্রোতারাও যেন অন্তর দিয়ে মিশে গেছেন ওই গানের সুরের গহিনে। পনেরো কুড়িটির মতো স্টল অর্ধবৃত্তাকারভাবে স্থাপিত। তার কয়েকটি থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখা যাচ্ছে। তার মানে চুলা জ্বলছে। আমরা এগিয়ে যাই। একি! এ যে একেবারে পিঠামেলা! ঢাকা মহানগরীর ক’জন গৃহিণী এমন বাহারি পিঠার পসরা সাজান নবান্নকে আবাহন জানাতে! সাধ ও সাধ্যের মধ্যে যে মেরু দূর ব্যবধান। তবে মানতেই হবে বিভিন্ন পালাপার্বণে ঢাকায় যেসব মেলা বসে তাতে অনেক সময় এ ধরনের পিঠা তৈরি ও বিক্রির ধুম পড়ে যায়। যে শিশুটির এখনও পর্যন্ত গ্রামে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, যে কুপার্স কিংবা প্রিন্সের দামী কেকের বাইরে এ রকম সব মজাদার ‘কেক’ আছে তা জানতেই পারেনিÑ তার জন্যে এইসব মেলা পিঠাবাড়ি হয়ে ওঠে। রমনাতেই দেখলাম শিশুটিকে তার মা পিঠা খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। শিশুটি কিছুতেই খাবে না এমন অচেনা খাবার! পরে মা বাধ্য হয়ে কিনে নিলেন কয়েক রকমের পিঠা। এই মেলায় কমপক্ষে এক কুড়ি ধরনের পিঠা সাজানো ছিল নগরবাসীর রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য। আমরা তা থেকে কয়েকটির নাম তো বিলক্ষণ বলতে সক্ষম হব। পিঠার ভেতর রয়েছে : ভাপা, পাকন, পুলি, পাটিসাপটা, রসের পিঠা, নকশি পিঠা...। ডিম চিতই আগে খাওয়া হয়নি। এ তো দেখছি রীতিমতো বাংলা পিৎজা! আহা ঢাকায় নানা ছলছুতোয় প্রতি ঋতুতেই হোক এ জাতীয় মেলা ও উৎসব। রাস্তা পার হতে গিয়ে জরিমানা ২৫ নবেম্বর মঙ্গলবার, বেলা ১১টা। ঘটনাস্থল : বাংলামোটর ফুট ওভারব্রিজের পাদদেশ। ক্যামেরা প্রস্তুত, রিপোর্টার উঁচিয়ে রেখেছেন মাইক্রোফোন। যে কোন সময়েই নাট্যপর্ব ধারণ করা হবে। সড়কদ্বীপে পুলিশের জটলা। মহিলা পুলিশের কণ্ঠে সাবধানবাণী উচ্চারিত হচ্ছে জোরেশোরে জনতার উদ্দেশে : ‘যত্রতত্র রাস্তা পারাপার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হন।’ যারা এই বাণী উপেক্ষা করে সড়ক পথেই রওনা হচ্ছেন রাস্তা পার হওয়ার অভিপ্রায়ে, তাদেরই ধরে আনা হচ্ছে ওই সড়ক দ্বীপে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার ছাড়া রাস্তা পারাপার হলে আইন অনুযায়ী ২০০ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার পুলিশকে দোষ দেয়া যাবে না। তারা আগেভাগেই এ ব্যাপারে প্রচারে নেমেছে। সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। কিন্তু ক’জনই বা এ ব্যাপারে ওয়াকিফহাল। তাই রাস্তা পার হতে গিয়ে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ক’বছর আগের কথা। এই বাংলামোটর মোড়টিতেই রাস্তা পার হতে গিয়ে মোটর গাড়ির আঘাতে মারা যান জনকণ্ঠের সাংবাদিক কবি ইউসুফ পাশা। সে সময়ে জনদাবির মুখেই এখানে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। প্রথম প্রথম এই ব্যস্ত ক্রসিংয়ে পথচারীরা ওটি ব্যবহার করতেন। যদিও পরে অধিকাংশ পথচারীই আর ওটি ব্যবহার করছিলেন না। সময় বাঁচানোর জন্য, একটুখানি অতিরিক্ত কষ্ট এড়ানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হুড়োহুড়ি করে রাস্তা পার হওয়াটাই চেনা দৃশ্য হয়ে ওঠে। বহুকাল বাদে ডিএমপি-র উদ্যোগে পথচারীদের জন্য ঘোষিত হলো এ অবশ্য পালনীয় নির্দেশনা। এতে জানে বেঁচে যাবেন বহুজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু পথ চলার বিড়ম্বনা কিছু কমবে না। কারণ ফুটপাথগুলো বেদখল। সঙ্কীর্ণ সড়কে গাড়ির বেপরোয়া চলাচল। কর্তৃপক্ষ যদি মানুষের হাঁটাচলার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সমান্তরালে যত্রতত্র গাড়ি থামানো আর দ্রুতগতিতে বেপরোয়া গাড়ি হাঁকানোদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামত। শীতের স্বরবর্ণ অগ্রহায়ণ মাসে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করলেও ঢাকায় শীত নামে আরেকটু পরে। এবার আর তার তর সইল না। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করেই বেশ শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। ২৫ নবেম্বর ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি চলে আসে গভীর রাতের ঢাকার তাপমাত্রা। ফুটপাথের গরম কাপড়ের দোকানগুলোও সরগরম হয়ে উঠেছে। নগরের পাবলিক মিনিবাসগুলোর জানালা রাতের বেলা সপাসপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর বিকেলগুলো এত সংক্ষিপ্ত! ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে বইছে উত্তুরে হিমহিম হাওয়া। তবে সাবধানীরা আগেভাগেই শীতের বর্ণমালা পড়তে শুরু করে দিয়েছেন। তোরঙ্গ থেকে তাদের গরম কাপড় নামানো সারা। দুঃসহ গরমের এই শহরে শীতকে অভ্যর্থনা জানায় কেবল তারুণ্য। বয়সীরা প্রাণপণে জবুথবু হয়ে থাকা এড়াতে চান। ধুলো-ধোঁয়ার এই শহরে শীতকালে কিছু ব্যাধির কামড় যে এড়াতে পারেন না অনেকেই। ঢাকায় যা শৈত্যপ্রবাহ বলে বিবেচিত ইউরোপে সেটাই স্বাভাবিক তাপমাত্রা। ছয় থেকে দশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় সেখানে চমৎকার সুস্থ থাকা যায়। অথচ ঢাকায় এমন শীতে অসুস্থ হয়ে পড়া যেন নিয়তি। শীতের ছোটগল্প শেষ করা যাক একটা অনুভব প্রকাশের মাধ্যমে। সেটি হলোÑ শীত নাগরিক শিক্ষিত ব্যক্তিকে আপন দর্পণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নিজের জীবনের দিকে মানুষ নিবিড় করে ফিরে তাকায়; ফিরে তাকায় শৈশবের স্মৃতির দিকেও। ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে, গায়ে রোদ্দুরের গন্ধ মেখে নিজের সঙ্গে কথা বলা। শীত যেটুকু জৈবিক যন্ত্রণা দেয় তা প্রতিরোধযোগ্য। যিনি সামর্থ্যবান তিনি শীতের এই কষ্ট দেয়ার প্রবণতাটি মনে রেখে শীতবস্ত্রহীনের সহায় হবেন এটাই এখনকার চাওয়া। রাতভর সুরের উৎসবে গ্রামবাংলায় এখনও রাতভর যাত্রাপালার আসর বসে। এককালে নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবনে শীতমৌসুমে কিংবা বছরের কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে রাত জেগে যাত্রা কিংবা সার্কাস দেখাই ছিল প্রধান বিনোদন। দিন পাল্টেছে, বিদ্যুত এখন সর্বত্র। তাই টিভিতে বিদেশী চ্যানেল দর্শন অথবা কম্পিউটারের পর্দায় ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করা হালফিল সিনেমা উপভোগ খুবই সম্ভব। রাজধানী ঢাকায় হাজারো বিনোদন পসরা। এর সবই যে রুচিকর ও উচ্চাঙ্গের এমন দাবি কেউ করবেন না। সারারাত জেগে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার শ্রোতা-দর্শক উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শুনবেনÑ এমনটা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। বিগত তিন বছর ধরে নবেম্বরের শেষার্ধে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদোগ ও আয়োজনে আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় দেশের সঙ্গীতপ্রেমী সম্পর্কে আমাদের পূর্বধারণা বদলে গেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভেতরেও যে রাগনির্ভর সঙ্গীতের জন্যে গভীর পিপাসা রয়েছে এ পরিচয় জানাটা পরম আনন্দের। বিপুলসংখ্যক মানুষ কম্পিউটারে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে ফ্রি প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে নিয়েছেন। এবার উৎসব গড়িয়েছে পাঁচ দিনে। আগের বছর ছিল চার দিন। ২৭ নবেম্বর বৃহস্পতিবার উৎসবের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় আর্মি স্টেডিয়ামের সব গেটেই ছিল সঙ্গীতপ্রেমীদের দীর্ঘ সুশৃঙ্খল লাইন। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল কর্তৃপক্ষ গোটা ভেন্যুকেই উৎসবের রঙে সাজিয়েছে। মূলমঞ্চ গতবারের চেয়ে প্রশস্ত, ব্যাকড্রপস্ক্রিনে নকশিকাঁথার কারুকাজসহ নানান নকশার ডিজিটাল উপস্থাপন আর রঙের খেলা। মঞ্চের দু’পাশেই রয়েছে বিশালাকৃতির মনিটর। আগে দর্শকসারির মাঝখানে ও শেষে কয়েকটি মনিটর ছিল যেগুলোর পর্দায় লাইভ প্রদর্শিত হতো মঞ্চপরিবেশনা। এবার মাথার ওপরেও টেকসই ছাউনি স্থাপনের জন্য ধাতুর স্তম্ভের প্রয়োজন হয়েছে। তারপরও ভেতরে বামপাশে অন্তত দুটি মনিটর স্থাপন করলে দর্শকশ্রোতাদের সুবিধে হতো। যা হোক গ্যালারিজুড়ে বিরাটাকৃতির সব ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। এ ছবিগুলো গত দুই বছরের উৎসবের বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনার। পুব দিকে খাবারের দোকানের সারি। লাগোয়া বিস্তৃত পরিসরে গোলটেবিল-চেয়ার সাজানো। রীতিমতো বিয়েবাড়ির খাবারঘর। দক্ষিণ দিকে উপমহাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসনির্ভর প্রামাণ্য সব আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে বিশদ লিখিত বর্ণনাসহ। ছড়ানো রয়েছে পুব-পশ্চিমে কফিশপ। আছে বুকস্টলও সে এক এলাহি কা-! অতীতের ভুল ও সমালোচনা থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়। বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রায় অনুপস্থিতি ছিল আগের দুটো উৎসবে। এবার প্রতিদিনই থাকছে দেশের কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যশিল্পীদের পরিবেশনা। ভারতের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ভুবনের খ্যাতনামা সব ওস্তাদ ও প-িতবর্গ এ মহোৎসবে যোগ দিয়েছেন। শিবকুমার শর্মা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, রাজন মিশ্র-সাজন মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয়, অজয় চক্রবর্তী, কৌশিকী চক্রবর্তী এই উৎসবের নিয়মিত শিল্পী হয়ে উঠেছেন। তাঁদের পরিবেশনার প্রতি বিশেষ আকর্ষণও তৈরি হয়েছে ঢাকার সুররসিকদের। এবারের গিরিজা দেবী ও রশীদ খানকে মিস করবেন বহুজন। নতুন যোগ দিলেন যেসব বিশিষ্ট শিল্পী এবং যাদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে দেশী সমঝদারদের তাদের ভেতর আছেন : আমজাদ আলী খান, কিশোরী আমানকর, উল্লাস কাশালকর প্রমুখ। এছাড়া গ-েচা ভ্রাতৃদ্বয়Ñ উমাকান্ত ও রমাকান্ত গ-েচা, রুচিরা কেদার এবং ভরতনাট্যম শিল্পী মালবিকা সারুক্কাইও উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। শিল্পীরা বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশের বটে, তবে দর্শকেরা বহু দেশের। শুধু মার্কিনী বা কানাডিয়ান নয়, ব্রিটিশ-অস্ট্রেলীয়সহ ভিনজাতির সঙ্গীত পিপাসুরাও রাতভর গান শুনছেন। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে রাত ৩টার দিকে ১৪নং গেট দিয়ে বেরুনোর সময় দেখি গ্যালারিতে উপস্থিত এক বিদেশিনীর কোলে শিশু, নবজাতক বলাই শ্রেয়Ñ এত অল্প বয়স! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শ্রোতৃম-লের দিক বিচারে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। রাতভর নান্দনিক পরিবেশে সুরের ঝরনায় নিবিষ্ট মোহমুগ্ধ অবগাহনÑধ্রুপদ, খেয়াল, তারানা, ঠুমরি, ভজনের মোহময় জগতে এ অভাজনের পর্যটন ভবিষ্যতের জন্যে সুখস্মৃতির ভা-ার হয়ে থাকবে। [email protected]
×