ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ে উত্তেজনা

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ে উত্তেজনা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ “আমরা পাহাড়ী মানুষের অধিকার চাই, ভূমি কমিশনের বাস্তবায়ন চাই, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। ১৭ বছর ধরে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতীক্ষা করতে করতে আদিবাসীদের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়া হচ্ছে, আদিবাসী নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন সন্তু লারমা। মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৭তম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি অভিযোগ করেন, পাহাড়ী জনগণের হাতের অস্ত্র কেড়ে নেবার জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান মানবেন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) আরও বলেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করে কথা রাখেনি। তার দাবি, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে যা বলছে তা সঠিক নয়। সন্তু লারমা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে পয়লা মে থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে ‘কালোচুক্তি’ দাবি করে এই চুক্তি বাতিল এবং আদিবাসী নেতা সন্তু লারমাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটলার বাঙালীদের সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন’। ২৯ নবেম্বর জনসংহতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৫ সালের ১ মে থেকে অসহযোগ আন্দোলন করার হুমকি দেন সন্তু লারমা। তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেন, তাঁর ওই আন্দোলনের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতা ও রাঙ্গামাটির সাবেক সাংসদ দীপঙ্কর তালুকদার বলেছেন, অসহযোগ আন্দোলনের হুমকি রাজপথে মোকাবেলা করা হবে। দীপঙ্কর তালুকদারকে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘জাতীয় কুলাঙ্গার’ উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনকে তিনি রাজপথে মোকাবেলার কথা বলেছেন। তাঁকে আমি বলি, শুধু রাজপথ কেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে পাহাড়ের অলিতে-গলিতে মোকাবেলা করা হবে।’ উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সংগঠনের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, ১৭ বছর পরও এই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হবার কারণে জনসংহতি সমিতি মনে করছে সরকার চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়েছে এবং আদিবাসী জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলের মাধ্যমে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে’ পরিণত করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। তিনি জোরকণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের এই ঘোষণা শুধু মুখের কথা নয়। প্রকৃত দাবি না মানলে তার বাস্তব রূপ দেখবে সরকার।’ পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আলোচনা সভার সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ ঘোষণা দেন। দিবসটি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে প্রচারিত একটি বিবৃতিতে সন্তু লারমার ঘোষিত দাবি উল্লেখ করে প্রকাশ করা হয়েছে, ‘আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে সরকার পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচীভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ১ মে ২০১৫ সাল থেকে (১) পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা হবে এবং (২) চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থবিরোধী সকল কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করা হবে।’ আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ সকল সংসদ সদস্যকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ অধিবেশন বসানোর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জরুরীভাবে পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা সরকারের নৈতিক, সাংবিধানিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, ‘ধর্ম ও নাগরিকত্ব পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু একজন বাঙালী যেভাবে চাকমা বা গারো হতে পারেন না, তেমনি একজন গারো কখনও বাঙালী হতে পারেন না। এই সত্যটা আমাদের শাসকগোষ্ঠীকে বুঝতে হবে। ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘শান্তিচুক্তি একটি জাতীয় চুক্তি। রাষ্ট্র সরে যেতে পারে, জাতি সরে যেতে পারে না। একজন বাঙালী, মুক্তিযোদ্ধা এবং নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত। শান্তিচুক্তির নামে ইউনেস্কো ও নেহরু শান্তি পুরস্কার দেশে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে অন্যতম স্বাক্ষরদাতা সন্তু লারমারা কি পেয়েছেন? রাঙ্গামাটির স্বতন্ত্র এমপি উষাতন তালুকদার অভিযোগ করেন, কোন এক অদৃশ্য শক্তি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, ‘সরকারের ভেতরে সরকার আছে, যারা নানা গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ চালাচ্ছে। না হয় এতদিন শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের বাইরে থাকত না। অনুষ্ঠানে অন্যানের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হাজেরা সুলতানা এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন সদস্য ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ। দিনব্যাপী এ আলোচনা সভা উপস্থাপনা করেন দীপায়ন খীসা। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৭তম বর্ষ পালন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনাবাসীদের সংগঠন বিএনপি- জামায়াতের ২০ দলীয় জোটের অঙ্গ সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মনিরুজ্জামান মনির, ইসলাামিক পার্টির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আবদুল মবিন এবং প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডভোকেট আবিদ রেজা। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে সমাবেশ করে তারা ৯ দফা দাবি জানিয়ে লিফলেট বিতরণ, কালোব্যাজ ধারণ এবং কালো পতাকা প্রদর্শন করেন।
×