ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বার্গম্যানকে জরিমানা, কোর্টে বসে থাকার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বার্গম্যানকে জরিমানা, কোর্টে বসে থাকার নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্য করে আদালত অবমাননার দায়ে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সারাদিন কোর্টে বসে থাকার নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদ- ভোগ করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, যারা এই বিচারিক কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে চায় তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন তিনি। আদালত আরও বলেছে, তিনি বাঙালী জাতির আবেগকে আঘাত করেছেন। তার লেখার উদ্দেশ্য ভাল ছিল না। তাঁর লেখার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাকে আমরা সতর্ক করছি যে, ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত এ রকম বিষয় নিয়ে যেন আর কোন সমালোচনা না হয়। মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই রায় প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। এদিকে ট্রাইব্যুনাল তার রায় প্রদান করার পর ডেভিড বার্গম্যান নিজস্ব ব্লগে আবারও রায় প্রদানসহ নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ডেভিড বার্গম্যান নিজস্ব ব্লগে ‘কমেন্ট অন টুডেজ কনটেম্প জাজমেন্ট’-এ দু’পৃষ্ঠাব্যাপী সমালোচনা করেছেন। ব্লগে তিনি লিখেছেন, আমি পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। প্রাথমিকভাবে আমি অনুভূতি প্রকাশ করছি। রায়ে একটি পক্ষ হয়ে কাজ করছি এটায় আমি শোকাহিত ও বিস্মিত হয়েছি। আমার আইনজীবী তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, প্রথমত, এই ব্লগগুলো পোস্ট করেছি বছর দুয়েক আগে। সাধারণত আদালত অবমাননা করার ও তার সঙ্গে সঙ্গে এই আবেদন করতে হবে। কিন্তু এত দেরিতে কেন করা হলো। দ্বীতিয়ত, এটা করা উচিত ছিল রাষ্ট্রপক্ষের কিন্তু করেছে তৃতীয় পক্ষ। তৃতীয়ত, যে পযেন্টের ওপর করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সাংবাদিকরা যে কোন কথাই বলতে পারেন। সাংবাদিকদের বাকস্বাধীনতা সবক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য। এই রায়ের ফলে আমাদের কোন সাংবাদিক আর কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবেন না। তাঁর এই ব্লগের পর আইনজীবীরা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর বিচারপতিবৃন্দ হাইকোর্টেও সমমর্যাদাসম্পন্ন। কোন আদেশ দেয়ার পর তা নিয়ে সমালোচনা করা যায় না। সমালোচনা করলে সেটাও আদালত অবমাননার শামিল। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ. ম রেজাউল করিম বলেছেন, উপযুক্ত একটি আদালতের রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা পুনরায় আদালত অবমাননার শামিল। আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকারের জন্য উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু কোনভাবেই রায় প্রদানকারী আদালতের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় এমন মতামত বা মন্তব্য করা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বলেছেন, রায়ের পর তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এর মাধ্যমে আদালত অবমাননা হতে পারে না। মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে আরও বলেছে, তিনি একজন বিদেশী নাগরিক কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। তবে এটা সত্য যে, তিনি বাংলাদেশী একজন নাগরিককে বিয়ে করে এদেশে রয়েছেন। তিনি একজন সাংবাদিক। প্রাকটিস করেন না। কোন আইনজীবীও নন। শিক্ষকও নন, কোন রিসার্চাসার নন। তার মতো একজন লোক কোন ক্যাপাসিটিতে লিখল। উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই নানা ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এর আগেও তাকে সতর্ক করা হয়েছে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা এম কামারুজ্জামানের মামলার আপীলের রায় ঘোষণার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলায় বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দিয়েছেন বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। মঙ্গলবার ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার রায় প্রদানের দিন। ট্রাইব্যুনাল দীর্ঘ রায়ে ডেভিড বার্গম্যানের কঠোর সমালোচনা করে ভবিষ্যতে এ ধরনের মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে বলেছেন। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী পাঠ করা এই রায়ে বার বারই ডেভিড বার্গম্যানের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ সময় সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, তাঁর স্ত্রী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বার্গম্যানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান। অপরদিকে ছিলেন আইনজীবী মিজান সাঈদ। ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের পর ডেভিড বার্গম্যানের স্ত্রী ব্যারিস্টার সারা হোসেন (ড. কামাল হোসেনের কন্যা) বার্গম্যানকে দ- দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর চরম আঘাত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আদালত অবমাননার অভিযোগে ডেভিড বার্গম্যানকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সারাদিন কোর্টে বসে থাকার নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়ে আরও বলেছেন, ডেভিড বার্গম্যান কিভাবে বাংলাদেশে আছেন, সাংবাদিকতা করছেন তা খতিয়ে দেখতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত তার রায়ে বলে, ডেভিড বার্গম্যানকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এবং কোর্ট চলাকালীন তাকে বসে থাকতে হবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিস বরাবর জরিমানাকৃত টাকা দিতে হবে। অনাদায়ে তাকে সাত দিনের করাদ- ভোগ করতে হবে। মঙ্গলবার ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত মোট ৪২ পৃষ্ঠার ১৪ হাজার ৬শ’ ৪৩ শব্দ এক ঘণ্টা ধরে পাঠ করেন। ওই সময় সব মিলিয়ে প্রায় ১৫/১৬ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান। রায় পাঠ করার পর ট্রাইব্যুনাল তাকে আসামির কাঠগড়ার চেয়ারে বসতে বলেন। ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই আবেদন করেন হাইকোর্টের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ। পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট সাঈদ মিজান। আদালতে শুনানিতে তিনি বলেন, ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি ‘আজাদ জাজমেন্ট এ্যানালাইসিস-১, ইন এ্যাবসেন্সিয়া ট্রায়াল এ্যান্ড ডিফেন্স ইনডিকোয়েন্সি’ এবং ‘আজাদ জাজমেন্ট এ্যানালাইসিস-২, ট্রাইব্যুনাল এ্যাজাম্পশন’ শীর্ষক লেখা প্রকাশ করেন। এসব লেখায় ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-প্রাপ্ত পলাতক আবুল কালাম আজাদের রায় নিয়ে করা মন্তব্যেরও ট্রাইব্যুনালের মর্যাদাহানি হয়েছে বলে আবেদনে অভিযোগ করা হয়। সাঈদ মিজান শুনানিতে বলেন, ডেভিড বার্গম্যান ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার আগেই সেই রায় নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া বিচারাধীন বিষয় নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন তার লেখায়। এসব মন্তব্য বিচারিক আদালতের জন্য ‘হুমকিস্বরূপ এবং জনস্বার্থবিরোধী।’ এগুলো রায় নিয়ে জনগণের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি করেছে এবং ‘জাতীয় অনুভূতিকে’ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ডেভিড বার্গম্যানের ব্লগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় নিয়ে করা মন্তব্যেও আদালত অবমাননা হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ্যাডভোকেট মিজান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল বলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়, দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে লিখেছেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া এসব তথ্যের কোন ভিত্তি নেই।’ গত ১৮ মার্চ আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন ডেভিড বার্গম্যান। তাতে সন্তুষ্ট না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল ১৭ এপ্রিল তাকে আবারও জবাব দাখিল করতে বলে। ২৫ আগস্ট বার্গম্যানের পক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো দাখিল করা জবাবের বিষয়ে শুনানি করেন তার আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান। আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মিজান সাঈদ। ৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ বিষয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়। প্রসিকিউটরদের মধ্যে জেয়াদ আল মালুম এবং তুরিন আফরোজ শুনানিতে ছিলেন। যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে লেখালেখির জন্য বিচারপ্রার্থী আন্দোলনের কর্মীদের কাছেও সমালোচিত বার্গম্যান। এর আগে ২০১১ সালে ইংরেজী দৈনিক ‘নিউ এইজ’ এ মতামত কলামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় ডেভিড বার্গম্যানকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছিল ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ২০১১ সালের ২ অক্টোবর ‘এ ক্রুশিয়াল পিরিয়ড ফর আইসিটি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদালত অবমাননার অভিযোগে তখনকার প্রতিবেদক ডেভিড বার্গম্যান, নিউ এইজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং প্রকাশক আ স ম শহীদুল্লাহ খানকে কারণ দর্শাতে বলে ট্রাইব্যুনাল। শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ডেভিড বার্গম্যানকে সর্বোচ্চ সতর্ক করে আদেশ দেয়া হয়। সে সময় আদালত অবমাননা হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল শুধু ভাবমূর্তির বিবেচনায় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। আপীল বিভাগ থেকে বের করে দেয়া হয় ॥ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা এম কামারুজ্জামানের মামলার আপীলের রায় ঘোষণার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলায় বিতর্কিত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দিয়েছিলেন বিচারপতি। আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ সোমবার কামারুজ্জামানের মামলার আপীলের রায় ঘোষণা করেন, যাতে ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। রায় পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজী দৈনিক নিউ এইজের বিশেষ প্রতিনিধি ব্রিটিশ নাগরিক বার্গম্যান আদালত কক্ষেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে শুরু করেন। বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এ সময় তাকে দাঁড়াতে বললে বার্গম্যান উঠে দাঁড়ান। বিচারক তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আদালতকক্ষে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকাই নিষিদ্ধ। আপনি মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকেছেন, আবার কথাও বলছেন।’ এরপর বিচারক আদালত কক্ষ থেকে বার্গম্যানকে বেরিয়ে যেতে বলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলা ও রায় নিয়ে মন্তব্যের কারণে এর আগে একাধিকবার এ সাংবাদিককে সতর্ক করে ট্রাইব্যুনাল।
×