ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এইডস ॥ প্রতিরোধেই মুক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

এইডস ॥ প্রতিরোধেই মুক্তি

এইডস এক আতঙ্কের নাম, এক মরণ ব্যাধি, এক সংক্রামক রোগ। সারা বিশ্বেই আজ এই রোগের ছড়াছড়ি, এমনকি মহামারী। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ যেমন হেলপার টি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স সেল, মস্তিষ্কে ও গায়াল সেল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মানবদেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন যে কোন সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে। এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার এই অবস্থাকে এইডস বলে। এই অবস্থায় শরীরে প্রতিরোধ করার মতো কোন কার্যকরী কোষ না থাকায় যে কোন রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে নানা উপসর্গসহ এর বিস্তার ঘটে। ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম রোগটিকে শনাক্ত করা হয়। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যায়, যার কারণ নিউমোসিস্টিস ক্যারিনিয়াই নামক একটি জীবাণু, যার বর্তমান নাম নিউমোসিস্টিস জিরোভেসি। পরে আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাব ঘটে ক্যাপোসিস সারকোমা নামক একটি টিউমারের। অসচেতনতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, সুস্থ জীবনের অনুশীলন না করাটাই এই রোগের প্রধান ঝুঁকি। এইচআইভি সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হলোÑ এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কনডম ছাড়া যৌন মিলনের মাধ্যমে। সমকামী, বহুগামী ব্যক্তি এবং বাণিজ্যিক ও ভাসমান যৌন কর্মীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে গ্রহণের মাধ্যমে। যুব সমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহণ। আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি, অস্থিমজ্জা, চোখের কর্নিয়া ইত্যাদি শরীরে সংস্থাপনের মাধ্যমে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত টুথব্রাশ ও ক্ষত সৃষ্টিকারী যন্ত্রপাতি যেমন সুচ, সিরিঞ্জ, কাঁচি, বেড, রেজার, ক্ষুর ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা ডাক্তারি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলে। এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় অথবা প্রসবের পর বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর হতে পারে। এইচআইভি আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিবিড় ভৌগোলিক অবস্থান, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। শ্রমিক অভিবাসন ও মানব পাচার। সর্বোপরি এইচআইভি স¤পর্কে সচেতনতা ও তথ্যের অভাব। মনে রাখতে হবে এইচআইভি রোগের কোন লক্ষণ প্রকাশ না করেও এই ভাইরাস মানুষের শরীরে বছরের পর বছর সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং এ সময় অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। কারও শরীরে এইচআইভি আছে কি-না তা বাইরে থেকে অনেক সময় বোঝা যায় না। শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা করে এ ভাইরাসের সংক্রামণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই দেখা যায় অনেকে নিজের অজান্তেই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মনে রাখা দরকার কেউ এইচআইভিতে আক্রান্ত হলেই অন্য কাউকে ছড়ায় না। নিম্নে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো, যার ফলে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারেই নাই। যেমন- আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে করমর্দন করলে বা একই ঘরে বসবাস করলে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা, চলাফেরা ও খেলাধুলা করলে বা তাকে স্পর্শ করলে। একই পায়খানা এবং বাথরুম ব্যবহার করলে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত থালাবাসন, গাস, বিছানা, বালিশ ইত্যাদি ব্যবহার করলে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুথু বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। মশা, মাছির বা পোকামাকড়ের কামড়ের মাধ্যমে। এইডস রোগীর সংস্পর্শে আসা কোন স্বাস্থ্যকর্মী যেমন-চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। হাসপাতালে কমন ওয়ার্ডে এইডস আক্রান্ত রোগী ভর্তি থাকলে আশপাশে ভর্তিকৃত অন্য রোগীদের কোন অসুবিধা হবে না। যেহেতু এইচআইভির বিরুদ্ধে প্রতিষেধক কোন টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, তাই প্রতিরোধ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে এর থেকে নিস্তার পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। কার্যকরী কোন ওষুধপত্র আবিষ্কৃত হয়নি। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে যেমন ভুগবেন, এর সঙ্গে পরিবার বা সমাজের অন্যদের জন্যও হুমকি হয়ে থাকবেন। এইচআইভি প্রতিরোধের মূল উপাদান হলো শিক্ষা, সচেতনতা, ঝুঁকি অনুধাবনের মাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা। মানুষের চিন্তায় ও আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। শুধুমাত্র বিশ্বস্ত একজন স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখতে হবে। একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করতে হবে। নিরাপদ যৌনক্রিয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে অসংক্রামিত লোক এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ছাড়া যৌনমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। যারা শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নেয় তাদের বেলায় উৎকৃষ্ট উপায় হলো ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ না নেয়া। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এইচআইভি সংক্রামিত রোগীর সঙ্গে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সুঁই, সিরিঞ্জ, বেড বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার পরিহার করতে হবে। যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কারও যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে। যৌনসঙ্গীর এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে অথবা নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ব্যবহার করতে হবে। এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে। তবে যেসব মায়েরা প্রয়োজনীয় থেরাপি গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা শতকরা ৮৫ ভাগ রোধ করা সম্ভব। জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নারী-পুরুষ যে কোন মানুষের শরীরে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে ভয় পাওয়া, ঘৃণা করা বা তার কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত নয়। তাকে সমবেদনা জানানো, যতœ করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। রোগটি ঘৃণার হলেও মানুষতো আর কোন ক্রমেই ঘৃণার পাত্র নয়। তাই এইচআইভি অন্য কারও বা নিজের শরীরে পাওয়া গেলে কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এইচআইভি পজিটিভ হলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটবে না, তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একজন রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারবেন। রোগীর আশা ও আত্মবিশ্বাস অত্যন্ত জরুরী। মনে রাখবেনÑ যে কোন প্রকার দুশ্চিন্তা পরিহার করে স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যেতে হবে। কোনভাবেই ভেঙ্গে পরলে চলবে না, বরং মানসিকভাবে ভেঙে না গিয়ে সহজভাবে এর মোকাবেলা করতে হবে। অবাধ ও অবৈধ যৌনমিলন পরিহার করতে হবে। যৌন মিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার্য নিজের জিনিসপত্র যেমনÑ সেভিং রেজার, ব্লেড, ক্ষুর অন্যকে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। দৈনন্দিন চাকরি, ব্যবসা, স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম ও প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে চলতে হবে। সুষম, পরিমিত, পুষ্টিকর ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে বাচ্চা নিতে চাইলে বা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে সন্তান আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে বুকের দুধ পরিহার করা সম্ভব নয়, কারণ এটিই প্রধান পুষ্টি। যেহেতু এখন পর্যন্ত এইডসের কোন প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি, এবং চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এইডস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা, সে অনুযায়ী সচেতন হয়ে সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ জীবনযাপন করা। ধর্মীয় ও সমাজিক অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করা উচিত। মনে রাখা উচিত, এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা শুধুমাত্র এইডস হওয়ার সময়কে বিলম্বিত করে, পুরোপুরি নিরাময় করে না। জনগণের সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। লেখক : ডিন মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×