ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ কখন নিভিয়া গেল দুরন্ত আঘাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ কখন নিভিয়া গেল দুরন্ত আঘাতে

সবটা নয় তখনও। প্রশ্ন করলেন, দিল্লী কি খুব পরিচিত আপনার। না। অলিগলি চিনি না। তবে প্রধানমন্ত্রীর আস্তানা থেকে চিত্তরঞ্জন পার্কের আটঘাট। আমিও চিনি। চলুন প্রেসক্লাবে? প্রেসক্লাবে গেলে আপনাকে টাকা দিতে হবে, আমার জন্য। দিতে হবেই। ওয়েট করুন। ফোন করলুম চাঁদ জোশিকে, দোস্ত, প্রেসক্লাবে যাচ্ছি বাংলাদেশ সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে। চাঁদের কথা, গিয়ে বলবি, আমার কথা। সব ফ্রি। রাত ৯টার মধ্যেই আসছি। চাঁদ যোশি হিন্দুস্তান টাইমসের চীফ রিপোর্টার এবং সংবাদপত্র ট্রেড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। চাঁদের আরেকটু পরিচয়, পিসি যোশি-কল্পনা যোশির ছেলে। ফোন করেছিলুম টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিউজ এডিটর সুভাষ চক্রবর্তী এবং রিপোর্টার কিরিট ভৌমিককেও? হিন্দুস্তান টাইমসের এডিটর রন্জয় কার্লেকারকেও আসতে বলি? জগ্্লুলের কথা, আপনি এই মহারথীদের চেনেন? আপনার কি বন্ধু? আপনার টেলিফোনে এলো? ওদের দেখা পাওয়া, টিকি দেখা অসম্ভব। আলাপ করিয়ে দিন। জগ্্লুল তিন বছরের বড়, আপনি বলেন। চলুন বাংলাদেশ দূতাবাসের পার্টিতে। কেউ ঝামেলা করলে আমি আছি। যাই না। ইন্দিরা গান্ধীর প্রেস কনফারেন্সে আপনাকে ঢুকিয়ে দেব। চলুন। ‘রাজি নই। চার মাস পরে, দিল্লীতে আবার দেখা, চলুন রাষ্ট্রপতি জৈল সিংয়ের প্রেস কনফারেন্সে। ‘জগ্্লুল যতদিন দিল্লীতে, গেলেই মহানন্দ। বয়সে তিন বছরের ফারাক। বয়স ব্যতিরেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা। জানতুম না সেলিনা বাহার (হাবিবুল্লাহর কন্যা)-এর কন্যার নিকট-আত্মীয় আত্মীয়, বললেন, টেক্সাস্, ডালাসে, এক পার্টিতে, জগ্্লুল আমাদের নিবিড় আত্মীয়। এই আত্মীয়তা আমারও। জগ্লুল আহ্মদ চৌধূরীর আত্মীয়তা প্রত্যেকের, বাংলার মানুষের। বিষয়টি ভাববার, ভাবুন। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বাঙালীর আস্তানায় সমবেত কয়েকজন, নানা প্রসঙ্গে আলোচনা। বুন্ডেসলিগা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং যথারীতি বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মীয় জঙ্গী মৌলবাদীর উত্থান, রাজনীতি। কথা কাটাকাটি। কে একজন বললেন, ভারতের রাজনীতি নিয়ে জগ্লুল আহ্মদ চৌধূরীর বিচার বিশ্লেষণ পড়লে অভ্যন্তরীণ খবরের হদিস পাওয়া যায়। ভদ্রলোক ইদানীং খুব কম লেখেন। অন্য একজনের কথা, কেবল ভারত নিয়েই নয়, দক্ষিণ এশিয়া নিয়েও জগ্লুল আহ্মদ চৌধুরীর লেখা অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, এবং সুপাঠ্য। ইংরেজীতেও ওর লেখা পড়েছি। যারা পড়েননি, বললেন, কোন্্ কোন্্ কাগজে বেরয়, জানাবেন। নিশ্চয় ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে, জানাবেন। পড়ব। আলোচনা আবার অন্যদিকে, আড্ডায় যেমন হয়। জগ্লুল আহ্মদ চৌধূরীর লেখা অনেকদিন পড়িনি, মন্তব্য না করে মৌনতা অবলম্বনই সুবুদ্ধি। আশ্চর্য হই, আড্ডায় জগ্লুল আহ্মদ চৌধূরী আলোচ্য। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মুনতাসীর মামুন বা মুহম্মদ জাফর ইকবালের কলাম বা আরও দুই-একজনের লেখা নিয়ে ভালমন্দ তথা গালমন্দ শুনি কেবলমাত্র সংবাদপত্র-পড়ুয়া শিক্ষিতদের। তাও ভাল, বিদেশবিভূঁইয়ে কার কত টাকা, কে কি কাজ করে, দেশে কয়টি বাড়ি করেছে, কত বিঘা জমির মালিক, ব্যাংক ব্যালান্স কত, কোন্্ বাঙালী নিয়মিত মসজিদে যায়, রোজা রাখে, তারাবি নামাজ পড়ে, কার বৌ বোরখা, হিজাব পরে, হজ করেছে, হজ করে এসে টিভি ফেলে দিয়েছে (টিভি দেখা পাপ), কারা জার্মান রুটি, মাংস খায় না, তুর্কি দোকান থেকে হালাল মাংস কেনে, বাংলাদেশের দোকান থেকে কচুরলতি, করলা, মাছ, রাঁধুনীর মসলা কেনে, এই গল্প থেকে সাময়িক বিরতি। রেহাই। বার্লিনে তিন শ্রেণীর বাঙালী। গোটা ইউরোপ, আমেরিকায়। একদল উচ্চশিক্ষিত, বড় চাকুরে, ওরা গা-গতরে খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের সঙ্গে মেশে না। আরেক দল রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী (শতকরা ৯৯ জনই)। রেস্তরাঁয় করে, ওদের নিজস্ব গোষ্ঠী, মানে, ওরা এক দল। এবং ওরাই দলে ভারি। ওরা শিক্ষিতদের সঙ্গে মেশে না। ওদের কথা, আমাদের হেয় করে, বাঁকা চোখে দ্যাখে। আমাদের পার্টিতে ওদের ডাকি না। ওরাও আমাদের ডাকে না। তার মানে, বিদেশেও শ্রেণী, ক্লাস। বাংলাদেশি মেন্টালিটি। মঈন চৌধুরী ওরফে পিটু এই মেন্টালিটি বহু উর্ধে। তিনি নোয়াখালীর। একদা ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত, উদীচীর গায়ক। বার্লিনে তাকে ছাড়া গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। তিনি সমাজকর্মী, সোশ্যাল ডিপার্টমেন্টের চাকুরে। কে কোন্্ দেশের, কোন্্ শ্রেণীর বাছবিচার করার দায় থেকে মুক্ত। প্রত্যেক মানুষই সমান। যেহেতু ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, বোধ পাকা, ধর্মাধর্মের বালাই নেই। মঈন চৌধুরী ওরফে পিটু বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়েন ইন্টারনেটে। তার কাছ থেকেই খবর পাই বাংলাদেশের হালহকিকত। জানান ফোনে। শনিবার সন্ধেয় (বাংলাদেশ রাত এগারোটা?) পিটুর ফোন, ‘সেদিন আড্ডায় সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মদ চৌধুরীর প্রসঙ্গ আলোচিত, মনে আছে? আজ তিনি একটি বাসের আঘাতে নিহত, যে বাসে যাচ্ছিলেন, বাস থেকে নামেন, সেই বাসের আঘাতেই। চিনতেন তাঁকে? Ñ বলো কী? এই প্রশ্নে উত্তর সব সংবাদপত্রেই ব্রেকিং নিউজ, পড়ুন ইন্টারনেটে। ছবিসহ নিউজ। বিস্তারিত।’ না, সংবাদপত্র পড়ি না, ইন্টারনেটে। সন্ধ্যা প্রায়-শেষ, রাতের শুরু। আড্ডাও ভাঙছে। জগ্্লুল বললেন, চলুন প্রেসক্লাবে, আপনি আমার গেস্ট। বললুম, একজনকে ফোন করছি, আমরা ওঁর গেস্ট, পানীয় থেকে শুরু করে যা ইচ্ছে খাবো, টাকা দিতে হবে না। জগ্্লুলের প্রশ্ন, প্রেসিডেন্ট জৈল সিং না কি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করবেন। গতকাল পিএম-এর প্রেস কনফারেন্সে ছিলাম, আপনাকে দেখিনি? রসিকতা করে বলি, ঠিক ওই সময়ই রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলাম। অতঃপর দু’জনের হাসাহাসি। ফোন করলুম চাঁদকে (চাঁদ যোশি। হিন্দুস্তান টাইমসের চীফ রিপোর্টার। সংবাদপত্র ট্রেড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। চাঁদের বাবা-মা বিখ্যাত। পি সি যোশি, কল্পনা যোশি। বিয়ের আগে ছিলেন কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রামের কন্যা। চাঁদের স্ত্রী মানিনী চট্টোপাধ্যায়। তিনিও সাংবাদিক, লেখিকা)। চাঁদ বললেন, রাত আটটার পরে যাবো। তোমরা যাও, আমার নাম বলবে। খেতে শুরু করো। চাঁদকে নিয়ে নানা গল্প, কিংবদন্তি শুনেছেন জগ্্লুল, দেখা হয়নি। কেউ কেউ বারণও করেছেন দেখা বা আলাপ করতে। প্রেসক্লাবে চাঁদের সঙ্গে পরিচয়ে জগলুল অতিশয় প্রীত। কারণ বোধহয়, চাঁদ খাস চাটগাঁইয়া এ্যাকসেন্টে কথা বলেন। আড্ডায় একটি ইংরেজী শব্দও উচ্চারণ করেননি? প্রেসক্লাব খেকে বেরিয়ে চাঁদ সম্পর্কে মহা উচ্ছ্বসিত জগ্্লুল। পরদিন বিকেলে আবার দেখা পিটিআই অফিসে। পিটিআই দফতরে জগ্্লুলেরও একটি টেবিল-চেয়ার এবং ফোন। বাকি যে কয়দিন ছিলুম (চারদিন) প্রত্যেক দিন দেখা, আড্ডা, ডিনার। জগ্্লুল জানতে চাইলেন দিল্লীতে কেন এসেছি, কোথায় থাকছি। নিয়ে গেলুম যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকার গেস্ট হাউসে। গিয়ে যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা নাড়াচাড়া। বললেন, এবার বুঝেছি, এখান থেকে স্টোরি পাঠাচ্ছেন, বোল্ড হরফে নাম ছাপছে। চারমাস পরে আবার দিল্লীতে। দেখা, আড্ডায় খামতি নেই। বাংলাদেশ দূতাবাসে (রিং রোডে) পার্টি। জগ্্লুল বললেন, চলুন। বলি, আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁয়তারা, দূতাবাসে গেলেই, পরিচয় জেনে, গ্রেফতার করবে, দূতাবাসে আটকে রেখে পরদিন প্লেনে চালান করবে বাংলাদেশে। দূতাবাস তো বাংলাদেশের নিজস্ব জায়গা, এক টুকরো বাংলাদেশ। ভারত সরকার কিচ্ছু করতে পারবেন না। জগ্্লুল বিস্মিত। প্রশ্ন, কেন। হেসে বললুম, বাসস থেকে এসেছেন, দিল্লীর স্পেশাল করসপন্ডেন্ট, জানেন না, স্বয়ং জিয়াউর রহমানের অর্ডারে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াফত করা হয়েছে কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাসের মাধ্যমে। না, না আমিও পার্টিতে যাব না। চলুন চাঁদনি চকে। বিরিয়ানি, মোরগ খাওয়াব। জগ্্লুল থাকাকালীন তিনবার দিল্লীতে গিয়েছি। ইতোমধ্যে দিল্লীর অলিগলি চিনেছেন, নানা মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে বন্ধুতা। বিশেষত বাঙালী সাবাদিকদের সঙ্গে। জানতুম না সেলিনা জামান (বাহার)-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জগ্্লুল। বৈবাহিক সূত্রে। সেলিনা জামানই জানালেন টেক্সাসে (ডালাসে), ওর ছেলের বাড়িতে, পার্টিতে। বললুম, জগ্্লুল আমারও আত্মীয়, যখন দিল্লীতে ছিলেন। ওর সঙ্গে নানা স্মৃতি, ভোলা অসম্ভব। ওর মতো নিপাট ভদ্রলোক খুবই কম চিনি? নানা বিষয়ে জ্ঞানী। ভারত, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নখদর্পণে। জগলু ভাই চলে গেলেন, হত্যা করল বাস। বাস ড্রাইভার নির্দোষ? বিচার হবে না? শাস্তি হবে না? রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতার একটি লাইন, কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে। বাতাসের বদলে লিখছি আঘাতে। এই আঘাত আমার-আপনার সকলের। সব আঘাতই মৃত্যু তবে?
×