ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেকড়ের সন্ধানে কানাডাপ্রবাসী ‘যুদ্ধশিশু’ মনোয়ারা ক্লার্ক ঢাকায়

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

শেকড়ের সন্ধানে কানাডাপ্রবাসী ‘যুদ্ধশিশু’ মনোয়ারা ক্লার্ক ঢাকায়

রশিদ মামুন ॥ রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির সামনের রাস্তায় একটি কুকুরের বাচ্চা। হঠাৎ কেউ তাঁকে কোলে তুলে নিলে পথচারীরা নিশ্চয়ই অবাকই হবেন। এদেশের রাস্তায় কুকুর নয়, এমন অনেক শিশুকে দেখা যায়। এরা কোথায় কীভাবে থাকে, কী খায় তার হদিস নেই। সেখানে কুকুরের প্রতি প্রেম দেখানো তো দুষ্কর বটে। কিন্তু মনোয়ারা ক্লার্ক অথবা মনোয়ারা বেগম সোমবার অপরাহ্নে সেই প্রেমই দেখালেন। তাঁকে বোঝানো হলো এ চিত্র এই দেশের সবখানকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে যে পাপ্পির প্রেমে পড়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত এদেশের বন্ধুরা কুকুরটিকে কাঁটাবনে পশু-পাখি বিক্রেতার দোকানে নিয়ে গোসল করান। অতঃপর পড়ন্ত বিকেলে তুলে দেন মনোয়ারার কোলে। যেভাবে একদিন মনোয়ারাকে ‘সদ্যভূমিষ্ট বাংলাদেশ’ তুলে দিয়েছিলেন কানাডিয়ান ক্লার্ক পরিবারের কোলে। জীবন সংগ্রামের বহু বছর পর মনোয়ারা জানতে পেরেছিলেন তাঁর জন্মের ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে। তখন থেকে বাংলাদেশের প্রতি তার ভালবাসার শুরু। নিজেকে এই মাটির সন্তানই মনে করেন। ভাবতে পছন্দ করে তিনি একজন বাংলাদেশী। কিন্তু এই দেশ কেন তাঁকে থাকতে দিল না, কেন এই দেশের কোথাও জায়গা হলো না মনোয়ারার? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কানাডা থেকে রবিবার ঢাকায় এসেছেন তিনি। উত্তরের জন্য প্রস্তুত কী আমরা? মনোয়ারা বড় সরল। সবকিছু বোঝেন সরলরেখায়। আঁকাবাঁকা কথা যে তিনি বোঝেন না তা তাঁর উচ্ছল হাসিতেই বোঝা যায়। হালকা পাতলা গড়নের, শ্যামবর্ণের চেহারা সাদা পরিবারে বড্ড বেমানান। মনোয়ারা নামটি নিয়েও বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। কানাডিয়ানরা তাঁকে মনোয়ারা না বলে ‘ওয়ারা ওয়ারা’ ডাকেন। যা তাঁকে আরও পীড়া দেয়। খুঁজতে এসেছেন নিজের শেকড়কে। কোথায় জন্মÑ কে মা, কে আত্মীয়-পরিজন। হালকা পাতলা গড়নের মনোয়ারা মন খুলে হাসেন। চটপট কথা বলেন। শুনলেই বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করে ফেলেছেন তিনি। মনেয়ারা বলেন, তিনি প্রথম দত্তক নেয়া লিন্ডা-ক্লার্ক দম্পত্তির কাছে জানতে পেরেছিলেন একাত্তরে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি নির্যাতনশালার পাশ থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। পাশেই মরে পড়েছিল তাঁর মা। মনোয়ারার শরীরেও বেয়োনেট চার্জ করা হয়েছিল। এখনও শরীর তাঁর সাক্ষ্য বহন করছে। যদিও জীবনের এই গল্পটি মনোয়ারা শুনেছেন কিন্তু কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এর প্রমাণ পাননি। নির্যাতনশালার পাশ থেকে মনোয়ারাকে উদ্ধার করে পুরান ঢাকার ‘মাদার তেরেসা হোমসে’ রাখা হয়েছিল। ব্যস এতটুকুই জানেন মনোয়ারা। মনোয়ারা বলে চলেন, একাত্তরে বহু নারী ধর্ষিত হয়। জন্ম হয় অনেকের। এখানকার মানুষ কেউ তাঁদের দায় নিতে চাননি। এরপর হেল্কি ফেরি সহায়তায় ভ্যাঙ্কুভারের ক্লার্ক পরিবার মনোয়ারাকে দত্তক নেয়। প্রথম দত্তক নেয়া পরিবারে মনোয়ারার ঠাঁই হয়েছিল ১২ বছর। সেখানে খুব সুখের জীবন কাটাতে পারেননি। স্মৃতিগুলো যে সুখের নয় কথা শুনলেই বোঝা যায়। জীবনের বারোটি বসন্ত পেরোতেই মনোয়ারাকে তাঁরা তাড়িয়ে দেন। যখন সাহায্যের সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তখনই মনোয়ারা বড় একা। যদিও সৃষ্টিকর্তা মার্গারেট নিকল নামের আরেক মায়ের ভালবাসায় তাঁকে বেঁধে দেন। যেখানে মনোয়ারা শেখেন ভালবাসা কি। এখনও সেই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মনোয়ারার। মনোয়ারা বলেন, তিনি খুব ভালÑ খুব ভাল। তিনিই আমাকে ভালবাসা কি তা শিখিয়েছেন। মনোয়ারা আপ্লুত হন। আবার মিষ্টি করে হাসেনও। ওখানে কী করেনÑ জানতে চাইলে মনোয়ারা বলেন বলতে চাই না। কি করি বলতে চাই না। স্বামীর সঙ্গে মনোয়ারার এখন আর যোগাযোগ নেই। ছেড়ে গেছেন তাঁকে। একমাত্র মেয়ে জুলিয়াকে স্বামীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মাসের নির্দিষ্ট সময় জুলিয়া বাবার কাছে আবার অন্য সময় মনোয়ারার কাছে থাকে। কথা শুনে বোঝা যায়, সব থেকে বোধ হয় ভালবাসেন সেই জুলিয়াকেই। নিজের মাকে দেখেননি ভালবাসাও পাননি, থাকতে পারেননি নিজের মাটিতেও। মা মনোয়ারা মেয়েকে ভালবাসেন এটাই স্বাভাবিক। মনোয়ারা খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে এদেশে এসেছেন। এর মধ্যে সব থেকে কঠিন প্রশ্নটি মনে হয় এটিই কেন যুদ্ধশিশুদেরকে আমরা আমাদের সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিতাড়িত করেছিলাম? তারা তো বাংলাদেশেরই সন্তান। শুধু সন্তানই নয়, এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশও তাঁরা। কিন্তু কেন তাঁদের জায়গা হলো না এদেশে। মনোয়ারা জানতে চান এর উত্তর। দেশের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি এই প্রশ্ন করবেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মনোয়ারার আরও অনেক জিজ্ঞাসাও রয়েছে তাঁদের কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও দেখা করতে চান তিনি। তবে কতটা পারবেন তা এখনও জানেন না তিনি। মনোয়ারাকে সব থেকে স্বস্তি দেয় দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এদেশের বন্ধুদের সঙ্গে। এদেশের একটি মাত্র ইংরেজি দৈনিকের নাম জানেন মনোয়ারা। খুব উচ্ছ্বসিতভাবে ওই দৈনিকটির নামই বলেন তিনি। দেশের খোঁজ রাখেন ওই দৈনিকটির মাধ্যমেই। মনোয়ারাদের দত্তক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের স্মৃতিচিহ্নগুলো মুছে দেয়া হয়েছিল। সঙ্গত কারণে ভ্যাঙ্কুভারের বাংলাদেশী মনোয়ারার আত্মীয় পরিজন খুঁজে পাওয়া বড্ড কঠিন হবে। এরপরও মনোয়ারা শরীরের বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন আর মায়ের লাশের পাশে পড়ে থাকা একটি শিশু সেখান থেকে পুরান ঢাকার মাদার তেরেসা হোমস এইটুকু কারও স্মৃতিতে থাকলে তিনি মনোয়ারার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেন।
×